Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৮ মঙ্গলবার, জুলাই ২০২৫ | ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

আইএস না আলকায়দা, বিশ্ব কাকে হুমকি ভাবছে?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৫৩ AM
আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:০১ AM

bdmorning Image Preview


দেড়যুগ আগে ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলা করে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে। তারপর থেকে বিভিন্ন ভাবে হামলা আর হুমকির মাধ্যমে বিশ্বকে আতঙ্কিত আর রক্তাক্ত করেছে আইএস। আইএস এর হুমকি যেন থামছেই না। তবে টুইন টাওয়ারে হামলার পর বিশ্ব ঠিকই নড়চড়ে বসে সন্ত্রাসবাদ নির্মুলে। আইএস এর কারণে থাকা আল-কায়েদার নাম তেমন একটা আলোচনায় আসেনি এতদিন। কিন্তু আল-কায়েদা শেষ হয়ে যায়নি; বরং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনটির পুনরুত্থান হয়েছে। তাদের বিস্তার, শক্তি-সামর্থ্য অনেক বেড়েছে।

আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হামজা বিন লাদেন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি তাঁর বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। এ জন্য হামজাকে নতুন হুমকি মনে করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ এবং জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হচ্ছে।

জাতিসংঘের একটি প্যানেল আল-কায়েদার হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছে। প্যানেল বলেছে, ইরাক ও সিরিয়ার শক্ত ঘাঁটি থেকে আইএস বিতাড়িত হওয়ার পর অঞ্চলটিতে পরবর্তী বড় সন্ত্রাসী হুমকি আল-কায়েদার কাছ থেকেই আসতে পারে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনটি নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া হয়েছে। গত মাসেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে আল-কায়েদাকে নিয়ে গুরুতর উদ্বেগের কথা আছে।

২০১১ সালে আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর অনেকটাই ‘ব্যাকফুটে’ চলে যায় জঙ্গি সংগঠনটি। পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রে চলে আসে আইএসের নাম। নৃশংসতা চালিয়ে তারা সব আন্তর্জাতিক মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়। অনেকটা আড়ালে চলে যায় আল-কায়েদার নাম। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, আল-কায়েদা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

আল-কায়েদার ‘সরব উপস্থিতি’ বিশ্ববাসীকে জানান দিতে চলতি বছর একাধিক বক্তব্য প্রকাশ করেছেন সংগঠনটির নেতা জাওয়াহিরি। বিশ্বজুড়ে আল-কায়েদার তৎপরতা, সাংগঠনিক সক্ষমতা, সদস্যসংখ্যাসহ সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান মনে করেন, সংগঠনটির পুনরুত্থান হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আল-কায়েদাকে এখনো একটি বৈশ্বিক জঙ্গি নেটওয়ার্ক হিসেবে দেখা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সোমালিয়া, ইয়েমেন, দক্ষিণ এশিয়ার মতো জায়গায় আইএসের চেয়ে আল-কায়েদা বেশি শক্তিশালী।

গত ৬ মার্চ নিউইয়র্কভিত্তিক থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ওয়েবসাইটে ‘আল-কায়েদার পুনরুত্থান’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে ব্রুস হফম্যান উল্লেখ করেন, চার বছর ধরে আইএস যখন খবরের শিরোনাম, তাদের নিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা চিন্তিত, তখন আল-কায়েদা নীরবে নিজেদের পুনর্গঠিত করেছে। মূল ঘাঁটি থেকে আইএস বিতাড়িত হওয়ার পর সেই শূন্যস্থান নিচ্ছে আল-কায়েদা। বিশেষ করে প্রভাব-প্রতিপত্তি, মানুষের কাছে পৌঁছানো, জনবল ও ঐক্যের দিক দিয়ে আল-কায়েদার সঙ্গে এখন আর পেরে উঠবে না আইএস।

আল-কায়েদার ব্যাপারে একই মত ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের ইনটেলিজেন্স প্ল্যানিং ডিরেক্টর জেনিফার কাফারেলার। তাঁর ভাষ্য, ১৯৮৮ সালের ১১ আগস্ট আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরের মাথায় আল-কায়েদা পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তারা সম্ভবত বৈশ্বিক জঙ্গিবাদী তৎপরতার নেতৃত্ব নিচ্ছে।

আল-কায়েদা ও তার অধিভুক্ত সংগঠনের অনুগত সদস্যসংখ্যা হাজারো বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দাবি করা হয়।

সিডনিভিত্তিক থিংক ট্যাংক লোই ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা ইন্টারপ্রিটার ওয়েবসাইটে গত ১৩ মার্চ সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যানের আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে বলা হয়, ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার প্রায় সাত বছর পর আল-কায়েদা সংখ্যাগত দিক দিয়ে আগের চেয়ে বড় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি দেশে আল-কায়েদার উপস্থিতি রয়েছে। স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার সক্ষমতা তাদের আছে। তারা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও রাশিয়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে হামলাও চালাচ্ছে।

ব্রুসের নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আল-কায়েদার প্রায় ৪০ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। ১০ থেকে ২০ হাজার যোদ্ধা সিরিয়ায়। সাত থেকে নয় হাজার সোমালিয়ায়। পাঁচ হাজার লিবিয়ায়। চার হাজার ইয়েমেনে। মেগরেব ও সাহেল অঞ্চলে চার হাজার। ইন্দোনেশিয়ায় তিন হাজার। প্রায় এক হাজার যোদ্ধা আছে দক্ষিণ এশিয়ায়।

সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে আল-কায়েদার বর্তমান নেতৃত্ব কৌশলগত ধৈর্য দেখিয়ে চলছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আল-কায়েদার আঞ্চলিক অধিভুক্ত সংগঠনগুলোও বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করছে। তারা স্থানীয় ইস্যুতে নিজেদের যুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ ‘খেলোয়াড়’ হয়ে উঠছে।

আল-কায়েদা দীর্ঘমেয়াদি খেলায় মনোনিবেশ করেছে বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের জেনিফার কাফারেলা। তাঁর ভাষ্য, আল-কায়েদার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য আছে। এই লক্ষ্য অর্জনে এখন তারা ধীর ও সতর্কতার নীতি অনুসরণ করছে।

সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান আল-কায়েদার পুনরুত্থানের নেপথ্যে কারণ উদ্‌ঘাটন করতে গিয়ে বলেছেন, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বসন্তের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী আল-কায়েদা।

তাছাড়া আল-কায়েদার পুনর্গঠন নির্বিঘ্নে করতে সংগঠনের বর্তমান নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্তও বেশ কাজ দিয়েছে। তিনি সংগঠনে বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায়নে গুরুত্ব দিয়েছেন। সংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সুরক্ষায় কৌশলী হয়েছেন। বিশেষ করে বেসামরিক মুসলমান ব্যাপকভাবে হতাহত হয়—এমন ধরনের হামলা এড়াতে কড়া নির্দেশ দেন। তারা সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি বাড়ান। আল-কায়েদা পরিকল্পিতভাবেই আইএসকে মনোযোগের কেন্দ্রে যেতে দিয়েছে। এই সুযোগে তারা সংগঠনের পুনর্গঠনে মন দিয়েছে।

আল-কায়েদাকে নতুন হুমকি কেন মনে করা হচ্ছে?

আল-কায়েদাকে নিয়ে উদ্বেগের অন্যতম কারণ ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হামজা বিন লাদেন। তাঁকে নিয়ে ভয়ের কথা জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আল-কায়েদার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পথে রয়েছেন হামজা।

ওসামা বিন লাদেনের দুই সৎভাই আহমাদ আল আত্তাস ও হাসান আল আত্তাসের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে গার্ডিয়ান। এই সাক্ষাৎকারে হামজা সম্পর্কে ভয়ংকর তথ্য উঠে আসে।

হামজার বয়স ২৯ বছর। তাঁর মা খাইরিয়া সাবার। ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে খাইরিয়া ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর হামজা প্রকাশ্যে ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস, তেল আবিবে হামলা চালাতে আল-কায়েদার অনুসারীদের আহ্বান জানান।

নাইন-ইলেভেনের হামলার শীর্ষ বিমান ছিনতাইকারী মিসরীয় নাগরিক মোহাম্মদ আত্তার মেয়েকে হামজা বিয়ে করেছেন বলে জানান আহমাদ ও হাসান। তাঁদের ধারণা, হামজা আল-কায়েদার শীর্ষ পদ পেয়েছেন। আর তিনি তাঁর বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করেছেন।

হামজার ব্যাপারে পশ্চিমা গোয়েন্দারা অবগত। তাঁরা দুই বছর ধরে হামজাকে খুঁজছেন। হামজাকে নিয়ে পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ভয়ের অন্যতম কারণ হলো তিনি অন্যদের চেয়ে অনুসারীদের অধিক উদ্দীপ্ত করতে পারেন।

পশ্চিমা গোয়েন্দাদের বরাত, আত্তার মেয়েকে হামজার বিয়ের বিষয়টিতে আল-কায়েদার বর্তমান চক্র সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। আর তা হলো নাইন-ইলেভেনের হামলার চক্রটি এখনো আল-কায়েদার কেন্দ্রেই রয়ে গেছে। ওসামা বিন লাদেনের উত্তরাধিকারকে ঘিরে আল-কায়েদা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

Bootstrap Image Preview