চা শ্রমিকরা নানা বৈষম্যের শিকার। এজন্য সরকার, বাগান কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি যৌক্তিক, ন্যায্য এবং অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি কাঠামো ঘোষণা এবং প্রতি ২ বছর পরপর তা হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
'চা বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৮ ডিসেম্বর) টিআইবির ধানমণ্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণসহ শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি এখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ৮ দফা সুপারিশ পেশ করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়।
গবেষক দলের অপর দুই সদস্য ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. গোলাম মোস্তফা এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রবিউল ইসলাম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জানানো হয়, গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের প্রথাগত ৬৪টি বাগান (৪১টি মূল বাগান ও ২৩টি ফাঁড়ি বাগান) থেকে ১৯১১ স্থায়ী শ্রমিকের সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার ও দলীয় আলোচনার মাধ্যমে এ গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, চা বাগানের শ্রমিকদের সর্বশেষ চুক্তিতে দৈনিক মজুরি মাত্র ১০২ টাকা ধরা হয়েছে যা দেশের অন্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম। আবার ক্যাশ প্লাকিং, নির্ধারিত টার্গেটের অতিরিক্ত পাতা তোলা ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য শ্রম আইন অনুযায়ী মূল মজুরির দ্বিগুণ মজুরি দেয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো বাগানেই তা দেয়া হয় না। অনেক বাগানেই আবার অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী শ্রমিকদের সমান বেতন দেয়া হয় না।
এছাড়া পাতা ওজন করার সময় অনেক বাগানেই সঠিক পরিমাপ করা হয় না বলে শ্রমিকরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। জরিপকালীন থেকে পূর্বের এক সপ্তাহের পাতা উত্তোলনের হিসাব যারা বলতে পেরেছেন (৬০.৩৯%) তাদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ শ্রমিক বিভিন্ন অজুহাতে পাতার ওজন কম দেখানোর কথা বলেন, যার প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমে সপ্তাহে ৩১ লাখ ২ হাজার ৪৩৫ টাকা (সব বাগানের ১ লাখ ৮৪৩ শ্রমিকের হিসাবে)।
উৎসব ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চুক্তি অনুযায়ী কোনো শ্রমিক বিগত বছরে কমপক্ষে ২৫০ দিন কাজ করলেই শুধু শতভাগ বোনাস পাবে অন্যথায় কম উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হারে বোনাস কাটা হয়।
এক্ষেত্রে বাবুদের ঠিকমতো হাজিরা না তোলা, শ্রমিকদের জন্য কোনো সার্ভিসবুক চালু না থাকা এবং শ্রমিকদের কাজের দিনের হিসাব ঠিকমতো রাখতে না পারায় বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের অনুপস্থিত দেখিয়ে শ্রমিকদের উৎসব ভাতা কম দেয়।
গবেষণা অনুযায়ী, চা বাগানে চাকরি স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক ৩ মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিশ কাল পার করার পরে স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও ৬৪টি বাগানের কোনোটিতেই তা মানা হচ্ছে না। শ্রম আইনে শ্রমিকদের স্থায়ী করার সময়ে নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেয়া হয় না; নিয়োগপত্রের বিকল্প হিসেবে সি-ফরম দেয়ার কথা দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও ৯২ দশমিক ৯ শতাংশকে কোনো নথি সরবরাহ করা হয়নি।
এছাড়া চা শ্রমিকদের ছুটির ক্ষেত্রেও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। শ্রম বিধিমালায় প্রত্যেক চা বাগানের কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত খাবার পানি সরবরাহের স্থায়ী ব্যবস্থা কোনো বাগানেই নেই। নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার।
বেশিরভাগ বাগানেই বিশ্রামাগার নেই। এছাড়া বাগানে কাজ করার সময় শ্রমিকদের সাপ, জোঁক ও বিষাক্ত পোকার আক্রমণ ও উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে চা বাগানে ওষুধ বা চুন ছিটানোর জন্য বারবার বলা হলেও বাগান কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয় না। কীটনাশক ছিটানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মাস্ক, গ্লাভস বা জুতা, চশমা, টুপি ইত্যাদি বাগান কর্তৃপক্ষের দেয়ার নিয়ম থাকলেও তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ শ্রমিকদের বাগান থেকে কিছুই দেয়া হয় না।
গবেষণা অনুযায়ী শ্রমিকদের চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের পড়ালেখার ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম ও সুশাসনের ঘাটতি দেখা যায়। বিধিমালায় শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও মাত্র ২৪টি বাগানে কর্তৃপক্ষের স্কুল রয়েছে। ৪০টি বাগানে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব স্কুল নেই এবং ৬টি বাগানে কোনো স্কুলই নেই।
শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক বাগানে হাসপাতাল বা ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠার নিয়ম থাকলেও জরিপকৃত ৬৪টি বাগানের মধ্যে ১১টিতে চিকিৎসা কেন্দ্র বা ডিসপেনসারি নেই। বিধিমালায় অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ দুই ধরনের চিকিৎসা সেবা থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও ৪১টি বাগানের চিকিৎসা কেন্দ্রে অন্তর্বিভাগীয় চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেই।
গবেষণাটিতে চা শ্রমিকদের জন্য কিছু ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। যেমন- কোনো শ্রমিক অবসরে গেলে কিংবা স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়লে তার পরিবারের একজন অস্থায়ী শ্রমিককে স্থায়ী হিসেবে চাকরি প্রদান, বাগানের হাসপাতাল কিংবা ডিসপেনসারি থেকে কর্মরত স্থায়ী শ্রমিক ও তাদের পোষ্যদের স্বাস্থ্যসেবা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের সাপ্তাহিক অবসর ভাতা প্রদান, স্থায়ী শ্রমিকদের মজুরির ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হিসেবে ভবিষ্যৎ তহবিল দেয়া, ২০ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি দেয়া- যা শ্রম আইনে ১৪ দিন এবং ১৪ দিন উৎসব ছুটি দেয়া- যা শ্রম আইনে ১১ দিন; ২ টাকা কেজি দরে রেশন দেয়া ও একজন স্থায়ী শ্রমিকের জন্য সর্বোচ্চ তিনজনকে পোষ্য হিসেবে রেশন দেয়াসহ বেশকিছু বাগানে ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।