জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ও সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে মনিটরিং সেল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস (এমডব্লিউইআর)।
আজ রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনে “তারুণ্যের নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা” শীর্ষক সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনটির আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ এ দাবি জানান।
এতে আরও বক্তব্য রাখেন এমডব্লিউইআরের সদস্য মো. আরিফুল ইসলাম, মারুফ আহমেদ, সাব্বির আহমেদ, আসাদুল্লা লায়ন। উপস্থিত ছিলেন আরমান সজীব, মো. নুর হোসেন ইমন ও শান্ত।
এ সময় লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার পর্যালোচনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ইশতেহারে ঘোষিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। যদিও বাংলাদেশে নির্বাচিত হওয়ার পর ইশতেহারের বিষয়টি কেউ প্রশ্নও করে না বা তা কতটুকু বাস্তবায়িত হলো সে সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পক্ষ থেকেও জবাবদিহিতা জনগণের কাছে করে না। আমরা চাই নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিটি সরকারের জনগণের কাছে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের বিষয়টি তোলে ধরা প্রয়োজন। এ জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।
আরিফ বলেন, মনিটরিং সেলটি ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সভাপতি/আহ্বায়ক- একাধিক সদস্য, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের একাধিক সদস্য, সংসদ সদস্য, বিরোধীদলের নেতা ও সংসদ সদস্য, শিক্ষার্থী, তরুণসমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক, পেশাজীবীদের মধ্য হতে কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং সেলটি গঠন করা হবে।
তিনি বলেন, মনিটরিং সেল পর্যবেক্ষণ করবে ইশতেহার অনুযায়ী কতটুকু কাজ করা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার ১০০ দিনের একটি প্রকল্প নিবে সেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয় একটি ৫ বছর, ১০ বছর, ২০, ৫০ বা ১০০ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। এ ছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এতে শিক্ষার্থী, তরুণসমাজ, শিক্ষক, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি একসাথে কাজ করতে পারে। আগামীতে যারা নির্বাচিত হবেন আশা করি বিষয়গুলো দৃষ্টি দিবেন।
তা ছাড়া বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের তরুণসমাজের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ, অভিনন্দন জানান এমডব্লিউইআর।
পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যক্রম সম্পর্কে মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে ২০২৩ সালের মধ্যে মিশন অথবা দূতাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ২। এসব দেশগুলোতে বাংলাদেশি বাজার সৃষ্টিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ৩। বৈধ উপায়ে দেশে রেমিটেন্স পাঠানো আরো সহজ করতে হবে।
তিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ এবং সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে বলেন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পেতে চায়। এজন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন মাথাপিছু ১ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। কিন্তু ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমান মাথা পিছু বিদ্যুতের পরিমাণ ৪৬৪ কিলো ওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের মাথাপিছু বিদ্যুতের পরিমাণ ৫৩৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে ১। বর্তমান বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী ৯১% থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ নিশ্চিত করা। ২। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রাধান্য দিয়ে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের নির্ভরতা ৬২% থেকে কমিয়ে ৩০% করার জন্য প্রযোজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ। ৩। মোট শক্তি উৎপাদনের ৫০% নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা। সে হিসেবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
বাসস্থান ও গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ে মারুফ আহমেদ বলেন, সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য দূর করার মহাজোটের চিন্তাটি প্রশংসনীয়। তবে গ্রামকে শহরে পরিণত করা কোনভাবেই ঠিক হবে না। গ্রামকে গ্রামীণ আবহে রেখে তার অবকাঠানো নির্মাণ, উন্নয়ন, অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ঠিক রেখে কাজ করতে হবে। শহরের সার্বিক যে নাগরিক সেবা সেটি গ্রামেও নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে সমন্বিত ও সুদক্ষ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। শহরকে যথাযোগ্য বাসোপযোগীতে শত/হাজার বছরের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে সাব্বির আহমেদ বলেন, ঐক্যফ্রন্ট ও মহাজোটের ইশতেহারে মিল শুধু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা। তবে নির্বাচিত সরকারের কাছে গণমাধ্যম নিয়ে আমাদের চাওয়া হচ্ছে, ১। অনলাইনসহ সকল গণমাধ্যমের জন্য একটি কার্যকর তথা চৌকস নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নকরণ। ২। পেশাদার সাংবাদিকদের চাকরির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও তা পালনে বাধ্য করা। ৩। গণমাধ্যমের সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন মজুরী বোর্ড গঠন ও তা কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। ৪। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বাধীন সাংবাদিকতায় হুমকিস্বরূপ ধারাগুলো রোহিতকরণ। ৫। কাগজে নয়, বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সড়ক যোগাযোগ, নৌ, রেল ও বিমানপথ সম্পর্কে আসাদুল্লা লায়ন বলেন, সড়ক পথের অধিকতর উন্নয়ন, নৌপথগুলো পুনর্রুদ্ধার ও রেলওয়ের জমি উদ্ধারসহ অত্যাধুনিক প্রকল্প গ্রহণের যে চিন্তা নেওয়া হয়েছে তা আশার আলো।
আমাদের দাবি হচ্ছে, ১. বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ২. যানজট নিরসনে যাবতীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. খাল-বিল, নদী-নালাগুলো পুনর্রুদ্ধার ও ড্রেজিং কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ৪. পানিপথের প্রাকৃতিক ¯্রােত বজায় রাখতে ব্যবস্থা নেয়া। পাশাপাশি ‘ডেল্টা প্লান ২১০০’ কে অভিনন্দন। সব ক্ষেত্রেই এমন শত বা হাজার বছরের প্লান নেয়া প্রয়োজন।
কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্র, মাঝারি, ভারী ও মৌলিকশিল্পস্থাপন বিষয়ে জীম মণ্ডল বলেন, ৪ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার কর্মহীন মানুষকে কাজে লাগানোর জন্যে দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শিল্পস্থাপন করতে হবে। শিল্পস্থাপনে দেশের স্থানীয় উৎপাদনকে প্রাধান্য দিয়ে ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন সময়ের দাবি। মহাজোট ১০০টি ইপিজেট স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এটি আশার দিক। তা ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রকল্পের দীর্ঘসত্রিতা নিরসনে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর আইন ও বিধিমালা সহজের ঘোষণা ভালো দিক। আমাদের দাবি হচ্ছে ১। শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ২। পরিবেশবান্ধব শিল্পস্থাপনে মনযোগ দিতে হবে। ৩। শিল্পের জন্যে তরুণদের বিনা বা স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে।
কৃষি, কৃষক, খাদ্য, পুষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন, কৃষি উন্নয়নে দুটি জোটের বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি। সে বিষয়গুলো আমরা সমর্থন করি। আমাদের দাবি ১। কৃষিজমি হ্রাস ঠেকাতে প্রতিটি উপজেলায় ‘কৃষি অঞ্চল’ গড়ে তুলতে হবে। ২। ওয়ার্ড পর্যায়ে কৃষিবিদ নিয়োগ, কৃষকদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া। ৩। গ্রামের পাশাপাশি “নগরকৃষি”কে প্রাধান্য দিয়ে ছাদ বাগানে উদ্বুদ্ধকরণ। ৪। কৃষিতে শ্রমিক সংকট নিরসনে প্রয়োজনে ওয়ার্ড/ইউনিয়ন পর্যায়ে চাহিদানুযায়ী কৃষিযন্ত্রপাতি দেওয়া, কৃষকরা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তা ব্যবহার করবে। ৫। সেচ প্রকল্পে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া নদী-খাল-বিল ড্রেজিং এর মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রবাহ চালু রাখা। ৬। মধ্যসত্ত সিন্ডিকেট ভাঙতে তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনবে সরকার। ৭। স্বল্প সুদে নয় বিনা সুদে খাদ্যশস্য উৎপাদনে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদান করবে। ৮। স্থানীয় উৎপাদনে অধিকগুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষেণে হিমাগার বা বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। ৯। ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমিবিরণ ও জেলেদের মাঝে জলমহাল বিতরণ নিশ্চিতকরণ। ১০। প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ফারুক আহমাদ আরিফ মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উদঘাটন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধিতে ব্যবস্থা নেয়া। সাথে সাথে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাসহ যেসব প্রতিশ্রুতি উভয় জোট নিয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। আমাদের দাবি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী অনার্স প্রথম বর্ষ, মুক্তিযুদ্ধের উপর সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল একটি বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনার্স তৃতীয় থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরতে হবে।