ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এক কলাম প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় এই মর্মে খবর প্রকাশ করেছে। শনিবার প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে সুবির ভৌমিক বলার চেষ্টা করেছেন,'এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরইএল) সংস্থাটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাচ্ছে।'
এর আগে ভারতের অপর মিডিয়া লুকইস্টকে সুবির ভৌমিক জানান, 'এএনএফআরইএলকে সহায়তা করার জন্য সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আদিলুর রহমান তার সংগঠন ‘অধিকার’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করে যাচ্ছে যা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হচ্ছে এএনএফআরইএল-এর ওয়েব সাইটে।'
আদিলুর রহমান, যিনি জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি নিরপেক্ষ নন বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে ফেলার জন্য এমনটি করছে বলে জানান সুবির ভৌমিক।
তিনি আরো জানান, 'যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকিতে পরিচালিত হচ্ছে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরইএল)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চাপ প্রয়োগ করে। মালয়েশিয়ায়ও একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের পর্যবেক্ষক সংস্থার মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ করে এবং বিভিন্ন বিবৃতি প্রদান করে দেশটির সরকারকে চাপে রাখে।'
সুবির ভৌমিক লেখেন, 'বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে একইভাবে বাংলাদেশের সরকার ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।'
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানান, 'জাতীয় নির্বাচনের আগে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরইএল) তার ৩২ পর্যবেক্ষকের ভিসা প্রদানে দেরি হওয়া আওয়াজ তোলে। মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিলার তার অ্যাম্বেসি স্টাফদের মাধ্যমে আলোচনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে ড্যান মজিনাও একইভাবে হাসিনা সরকারকে চাপে রাখতে এবং উৎখাত করতে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন বয়কটের কথা বলেছিল। তাদের ধারণা ছিলো, পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে ১ মাসও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা কাজ করেনি। তাই বলে কি মিলাররা থেমে যাবেন? মোটেও নয়। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন প্রস্তুতি নিয়ে এবার মাঠে নেমেছেন ডেভিড মিলার।'
স্বাধীন মার্কিন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে সুবির ভৌমিক লেখেন, ‘ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’ (এনইডি)-কে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতা পরিবর্তনে স্থানীয় জনমত তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সিআইএ। 'উইজার্ডস অব লাংলে' বইয়ের লেখক জেফরে রিচেলসন তার বইতে এ প্রসঙ্গে বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতই সিআইএ গোপনে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক দলকে সহায়তা করে আসছে, বিষয়টি নতুন নয়। ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়া নির্বাচনে সিআইএ ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (এনইডি)-এর মাধ্যমে সেখানকার বিরোধী দলগুলোকে সহায়তা করে। লক্ষ্য ছিলো স্যান্দিনিস্তাসের বামপন্থি সরকারকে অপসারণ। আর এ জন্য এনইডি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এই আর্থিক সহায়তা পাওয়ার পর দেশটির নিরাপত্তা সংস্থাটি ঘোষণা করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে এবং শেষ পর্যন্ত বামপন্থী স্যান্দিনিস্তাসে সরকারকে উৎখাত করা হয় (পৃষ্ঠা ৪১৪)।'
২০১৬ সালে পশ্চিমা গবেষক টনি কার্তালুসসি এএনএফআরইএল-এর কার্যাবলীর পর্দা ফাঁস করে জানান, 'থাইল্যান্ডের গণভোটকে প্রভাবিত করতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ হিসেবে থাকা থাকসিন সিনাওয়ত্রেকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করে যায় প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এ সময় থাইল্যান্ড দীর্ঘ রাজনৈতিক খরা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল গণভোটের মাধ্যমে।'
কার্তালুসসি বলেন, 'সিনাওয়াত্রেকে ক্ষমতায় আনতে তখনকার থাইল্যান্ড সরকারকে অনবরত চাপ প্রয়োগ করে যায় যুক্তরাষ্ট্র। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে একইভাবে বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।'
তিনি আরো লেখেন, 'এর মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনে নিয়োজিত ফ্রন্টগুলির মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উপর পশ্চিমা একচেটিয়া কর্তৃত্ব খাটিয়ে নিজেদের অপছন্দের গোষ্ঠীকে ক্ষমতাশীল ও অন্যায়কারী হিসেবে তুলে ধরা হয়।'
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে যেভাবে পর্যবেক্ষকদের ভিসা না পাওয়ার গুঞ্জন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যমে ঠিক তেমনিভাবে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট খবর প্রকাশ করে ব্যাংককের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ন্যাশন’। সেখানে বলা হয়, 'দ্য এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরইএল) জানিয়েছে, বারবার পর্যবেক্ষণের জন্য অনুমতির কার্ড চেয়েও পাচ্ছে না তারা।'
সেখানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মতই ‘দ্য ন্যাশন’ উল্লেখ করেনি এই এএনএফআরইএল প্রতিষ্ঠানটি কে বা কারা পরিচালনা করে, এর অর্থায়ন কোথা থেকে আসে এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াসহ এশিয়া জুরে তাদের ‘পর্যবেক্ষণ’ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য কী?
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে টনি কার্তালুসসি লিখেছেন, 'এই অঞ্চল থেকে কোন সহায়তা না নিয়ে, পর্যবেক্ষকদের এই সংগঠনগুলো তাদের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে যারা ঐতিহাসিকভাবে এশিয়া ও এ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এমন (স্থানীয় ও বিদেশী) ‘পর্যবেক্ষকেরা’ কাদের লক্ষ্য পূরণ করবে?'
সুবির ভৌমিক জানান, 'বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্র। কেননা, বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা তার বাবা ও বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পেছনে সিআইএ-এর ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। আর তিনি যতদিন ক্ষমতায় আছেন ততদিন সেইন্টমার্টিন দ্বীপে চীন মুখী মার্কিন নৌ ঘাঁটি স্থাপনের স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না।'
তিনি লেখেন, 'এরশাদের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯১ সালে হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেইন্টমার্টিন দ্বীপে সহায়তা প্রদানের নামে নৌ ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান করে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিজের উত্তরসূরিদের সেই পর্যবেক্ষণ ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে আলোচনার জন্য মিলার বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে এতটা মরিয়া। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণের পথে সবচাইতে বড় বাঁধা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেননা তিনি পূর্বেও এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি চীন সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের প্রস্তাব দিলে সেটিও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।'
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে সুবির ভৌমিক জানান, '২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারতের পূর্বের রাজ্যগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছে দেশটিতে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার। এই আমেরিকা তার বন্ধু সৌদি আরবকে বাঁচাতে জামাল খাশোগী হত্যার মত চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরও সৌদি যুবরাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের এত আস্ফালন স্পষ্ট প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতে কতটা মরিয়া।'
বিবিসির সাবেক এই সাংবাদিক চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেখ হাসিনার অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট করে লেখেন, 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ধারণ করেন বলেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এশিয়ায় চীন-যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী প্রতিযোগিতার অংশ হতে চান না। আর সে কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পছন্দের তাবেদার সরকার বাংলাদেশে বসাতে এত কিছু করছে।'