Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৭ বুধবার, মে ২০২৫ | ২৪ বৈশাখ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

জীবনযুদ্ধে হার না মানার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বশেমুরবিপ্রবির সুবর্না

রাশিদুল ইসলাম, বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৫:৪৭ PM
আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৫:৪৭ PM

bdmorning Image Preview


১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ প্রতিদিনের মতো সেদিনও সুর্বণা মজুমদার সদ্য ভর্তি হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করার জন্য যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রাস্তা পার হওয়ার সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় সে। হঠাৎ তার চিৎকারের আওয়াজে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ।

আশেপাশের লোকজন এসে পড়ে থাকতে দেখে তার থেতলে যাওয়া নিথর দেহ। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জের সদর হাসপাতলে, সেখানকার চিকিৎকরা জানায় রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ তার বাঁচার সম্ভবনা খুব কম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় নিতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে তাৎক্ষণিকভাবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়া হয় সুবর্ণাকে।

হ্যা এতক্ষণ জীবন যুদ্ধে জয়ী সেই সুর্বণা মজুমদারের কথাই বলছিলাম। সুবর্না মজুমদার ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। দুইটা বছর নিজের সাথে সংগ্রাম করে চলেছেন এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলেন, এইতো ভালো আছি বলে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুবর্ণা।

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমুনি গ্রামের এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম নেয় সুবর্ণা। চার বোনের মধ্যে সুর্বণা দ্বিতীয়। বড় বোনের যথেষ্ট মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে পাবলিক ভার্সিটি তো দূরের কথা জাতীয় ভার্সিটিতেও ফর্ম তুলতে পারেনি। টানাপোড়নের সংসারে বাবা পড়ালেখার খরচ চালাতে না পেরে নবম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে দেয় একই উপজেলার কালশিরা গ্রামে আশিস কুমার মণ্ডলের সঙ্গে।

কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, হার মানেনি কখনো নিজের সাথে। সংসারের সব কাজ সামলানোর পরও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে এবং কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে। কিন্তু স্বপ্ন ছিল তার আকাশ ছোয়ার। স্বপ্ন ছিল তার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তার এ স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেন তার স্বামী আশিস কুমার মন্ডল। যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টাররোলে কর্মরত।

অবশেষে সকল অভাব অনটন, প্রতিকুলতাকে পেছনে ফেলে ও অদম্য মেধার স্বাক্ষর রেখে সু্বর্না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সে কখনও ভাবেনি সে বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ার খরচ চালাতে পারবে। তবুও তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। শুরু হয় তার স্বপ্নের পথ চলা। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন থমকে যায় তার পথচলা। ঠিক আজকের এই দিনে মারাত্মক দুর্ঘটনার আহত হয়ে সুবর্না মজুমদার টানা ৭ (সাত) দিন আইসিইউতে থেকে ১৫ (পনের) দিনের মাথায় জ্ঞান ফেরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একান্ত আন্তরিকতায় তার চিকিৎসা চলে। সমস্ত ব্যয়বার বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আমি কে, তুমি কি আমাকে চেন মা, মৃদুস্বরটি ভেসে আসে তার কানে। তখন সে আবছা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে জবাব দেয় ‘জ্বী আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমাদের উপাচার্য।’ আর তখনই সে নিজেকে প্রথমবারের মতো হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে। বুঝতে পারে তার সেই পুরনো সাজানো গোছানো জীবন আর নেই নিমিষের মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সবকিছু।

সে তখন মুখ ঢুকড়ে কাঁদতে থাকে আর ভাবতে থাকে সে হয়ত আর পুরনো জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। পঙ্গুত্বকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হবে সারাটি জীবন, তার স্বপ্নগুলো বুঝি এখানেই ধুলিৎসাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অ্যাপোলো হাসপাতালে নিবির পরিচর্যায় চলতে থাকে তার উন্নত চিকিৎসা। দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকাকালীন দুই বার মাথা ও তিনবার পায়ের সার্জারিসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার প্রায় ১৮-২০ লক্ষ টাকা বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কান্না জড়িত কন্ঠে সুবর্ণা বলেন 'তার জন্ম হয়েছে দুইবার, একবার পিতা-মাতার ঘরে আর, অন্যবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।’

আসলেই সেই দূরন্তপণা সুবর্ণা কী ফিরে আসতে পেরেছে তার স্বভাবিক জীবনযাত্রায়, জানতে চাইলে বলেন- এখন সে আগের চেয়ে মোটামুটি সুস্থ। তবে বেশি সময় হাটলে একটু সমস্যা হয়, মাঝে মাঝে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হয় কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিন্তাও করতে পারে না।

এত প্রতিকূলতার মাঝেও সুর্বণা স্বপ্ন দেখে ভার্সিটির শিক্ষক হবার। সে জানায়, হাসপাতাল থেকে ফেরার ৭ দিনের মাথায়ই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন তার স্বামী আশিস কুমার মণ্ডলকে উপাচার্যের নির্দেশে মাস্টাররোলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্বল্প বেতনের চাকরির উপার্জন দিয়ে শত অভাব অনাটনের মাঝেও সে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, আর প্রহর গুণছে তার স্বামীর চাকরি স্থায়ী হবার।

পরিশেষে সে জানায়, চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে উপাচার্য, তার নিজ বিভাগের আনিসুর রহমান, মজনুর রশিদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শির্ক্ষাথীদের কাছে। যাদের ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণায় আজ সে নতুন করে স্বপ্নদেখতে শুরু করেছে।

সুবর্ণার ঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এখন চারটি গতিরোধক নির্মিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘গেল দুই বছরে আগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুবর্ণা মজুমদার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হলে আমরা তাকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য এম্বুলেন্স করে ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা করি। চিকিৎসার সমস্ত খরচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করে।

তিনি আরো জানান, শুধু সুবর্না নয়, অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন শিক্ষার্থীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, মরনব্যাধি রোগসহ যেকোন সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবসময় পাশে থাকবে। এ জন্য চিকিৎসা তহবিল নামে আলাদা একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।

Bootstrap Image Preview