উচ্চ আদালতের নির্দেশ অবজ্ঞা করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের নকশা (লে-আউট প্ল্যান) পরিবর্তন করে প্রায় শ'খানেক নতুন প্লট তৈরি করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দেড় থেকে ১০ বিঘা আয়তনের এসব প্লট ইতিমধ্যে গোপনে বরাদ্দও সম্পন্ন হয়েছে। আবার প্লট পেয়েও স্বস্তিতে নেই বরাদ্দপ্রাপ্তরা। কারণ, একদিকে প্লট পেতে তাদের মোটা অঙ্কের অনৈতিক লেনদেন করতে হয়েছে, অন্যদিকে বিষয়টি আদালতের নজরে পড়লে বরাদ্দও বাতিল হতে পারে।
জানা যায় , রাজউকের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বরাদ্দপ্রাপ্তদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজউকের ওয়েবসাইট ও রাজউক ভবনের নোটিশ বোর্ডেও তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি।
এ নিয়ে রাজউকের বোর্ড সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি) আমজাদ হোসেন খান রাজউক সম্পর্কে অনেক বিষোদ্গার করে বলেন, বিষয়টি পূর্বাচলের পরিচালক ও রাজউক চেয়ারম্যানই ভালো বলতে পারবেন।
রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক-২ (ভূমি ও সম্পত্তি) শেখ শাহিনুল ইসলাম প্রথমে বলেন, রাজউকের ওয়েবসাইটে তালিকা দেওয়া আছে। ওয়েবসাইটে কোথায় তালিকা দেওয়া আছে দেখতে চাইলে পরক্ষণেই বলেন, রাজউকের ওয়েবসাইট খুলতেই একদিন লাগে। এ জন্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। পরে আবার বলেন, বিষয়টি নিয়ে আদালতের কিছু ঝামেলা আছে। ঝামেলা শেষ হলে তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এসব প্লট বরাদ্দের স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে শাহিনুল ইসলামের বক্তব্য এখানে তার কিছুই বলার নেই। 'ওপর' থেকে যাদের প্লট দিতে বলা হয়েছে, তারাই পেয়েছেন। রাজউক চেয়ারম্যান বা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নেন। এছাড়া প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক সমকালকে বলেন, 'এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। শেখ শাহিনুল ইসলাম ও বোর্ড মেম্বাররাই ভালো বলতে পারবেন।
সম্প্রতি রাজউকের বোর্ড সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) থেকে পদোন্নতি পেয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পাওয়া রোকনউদ্দৌলা বলেন, প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আদালতের অনুমতি ছাড়া পূর্বাচলের লে-আউট প্ল্যান পরিবর্তন করা হবে না। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বোর্ডসভায় প্লটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের আগে সভার কার্যপত্রও আমাদের দেখানো হয়নি।
জানা গেছে, পূর্বাচল প্রকল্পের মূল লে-আউট প্ল্যান তৈরির পর থেকে বন-টিলা-জলাশয় ধ্বংস করে একের পর এক প্লট তৈরি করে আসছিল রাজউক। ফলে পরিকল্পিত উপশহর গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বসেছিল। এভাবে চারবার মূল নকশা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতিসহ (বেলা) আটটি পরিবেশবাদী সংগঠন রাজউকের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করে। অভিযোগ করা হয়, পরিবেশগত সমীক্ষা ও ছাড়পত্র ছাড়া প্লট তৈরি করায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চার বছর মামলা চলার পর ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে বলা হয় আদালতের অনুমতি ছাড়া পূর্বাচল প্রকল্পে কোনো ধরনের নকশার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন করা যাবে না। এলাকার স্বতন্ত্র পরিবেশ ব্যবস্থা, বন, জলাভূমি ও কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া বন, পার্ক, খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খাল, জলাশয়, সবুজ বেষ্টনীসহ পরিবেশগত স্থানে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না। পূর্বাচলের ভূমির প্রকৃতিও পরিবর্তন করা যাবে না।
ডাটা এক্সপার্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জাহাঙ্গীর কবির সমকালকে বলেন, পূর্বাচল প্রকল্পের বিরুদ্ধে বেলার দায়ের করা মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছিল। এ জন্য তিনি রাজউককে জানিয়েছিলেন আদালতের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না। তারপরও রাজউকের পীড়াপীড়িতে তিনি কৌশলে নতুন প্লটগুলো সৃষ্টি করে দেন এবং বলে দেন আদালতের অনুমতি নিয়ে যেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। রাজউক অনুমতি না নিয়েই প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। এখন আদালতের দৃষ্টিতে গেলে এই প্লট বাতিলও হতে পারে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দকরণ সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির সভা হয়। প্লট বরাদ্দ পেতে সাত ক্যাটাগরিতে ৪৭২টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ২৭৩টি আবেদন ত্রুটিপূর্ণ বলে বাতিল করা হয়। রাজউকের বোর্ড সদস্য (সম্পত্তি ও ভূমি) আমজাদ খানের সভাপতিত্বে ওই সভায় সাতটা ক্যাটাগরিতে ৮৪টি প্লট বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। দুদিন পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ডসভায় এসব প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সামাজিক অবকাঠামো ক্যাটাগরিতে ৩৯টি, নার্সারি স্কুল ক্যাটাগরিতে ১১টি, প্রাইমারি স্কুল ক্যাটাগরিতে ৪টি, সেকেন্ডারি স্কুল ক্যাটাগরিতে ৭টি, কলেজ-ইনস্টিটিউট ক্যাটাগরিতে ১৬টি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে ৫টি ও হাসপাতাল ক্যাটাগরিতে দুটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
রাজউকের বোর্ড সদস্য (পরিকল্পনা) আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই লে-আউট পরিবর্তন ও প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না। যা করার সম্পত্তি ও ভূমি শাখা এবং পূর্বাচল প্রকল্পের কর্মকর্তারাই করেছেন। এবং সব কিছু নিয়ম মেনেই করা হয়েছে।