রাস্তায় বের হলেই যেভাবে সেনা সদস্যদের জেরার মুখে পড়তে হয় সাধারণ কাশ্মীরিদের। তাতে স্থানীয় কাশ্মীরিদের কাশ্মীরে বসবাস করা এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। রাজ্যটির গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে গত সপ্তাহের আগে যুদ্ধবিমানের এমন গোঙানি নিকটাতীতে শোনা যায়নি। ছবির মতো দেখতে শ্রীনগরের কাছেই সীমান্ত দিয়ে চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নিয়মিত গোলাবিনিময়ের ঘটনা ঘটছে। এতে ভারত-পাকিস্তানের নাগরিকরা হতাহত হচ্ছেন অহরহ।
এটিই হচ্ছে শ্রীনগরের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। পরমাণু শক্তিধর ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতার মাঝখানে তাদের অবস্থান। দুই দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সেনা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে কাশ্মীর। পাহাড়েঘেরা এই ছোট্ট উপত্যকাটিতে প্রায় সাত লাখ ভারতীয় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে দাঙ্গা পুলিশ। ১৪ ফেব্রুয়ারির হামলার পর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় অভিযান চলছে। কাজেই পুলিশের বাধায় নিজের দোকানে যেতে পারেন না আবিদ খাপড়া। এতে তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে।
ক্ষুব্ধ হয়ে সে কথাই বলছিলেন এ কাশ্মীরি যুবক। তিনি জানান, যখনই আমি বাইরে বের হই, দেখি দাঙ্গা পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হয়রানির শিকার হই। দোকানে যেতে পারি না।
আবিদ বলেন, ভারতের কোথাও গেলে সেনাবাহিনী আপনাকে সহায়তা করবে। কিন্তু এখানে একজন সেনার কাছে অপরিচিত জায়গার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাবেন না। সেনাসদস্যরা যদি খারাপ কিছুও করে, তবে সে জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
একটি ক্যাফেতে খেতে গিয়ে পছন্দের খাবার পাননি ২২ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আবরু জান। তিনি বলেন, পুলওয়ামায় হামলার পর ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর আচরণে পরিবর্তন চলে এসেছে। সেনাসদস্যরা আমাদের তাদের শত্রু মনে করছে।
আবরু জান বলেন, একজন কাশ্মীরি হিসেবে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের বেদনা আমি বুঝতে পারি। আমরা সবাই কাউকে না কাউকে হারিয়েছি। আমাদের গ্রামে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। বন্দুকের গুলিতে তরুণদের আহত হতে দেখেছি।
বাইরে বের হলেই সশস্ত্র পুলিশের মুখোমুখি হতে হয় বলেও জানান এ মেডিকেলছাত্রী। বললেন, এখানে অনেক বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এখানে বহু সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতির এতই অবনতি ঘটেছে যে, কাশ্মীরিদের জন্য কাশ্মীর কোনো নিরাপদ বাসস্থান নয়।
‘পুলওয়ামার আগে মনে হয়েছিল, পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে। স্বাভাবিক না হলেও চলাফেরা করা যেত। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারত সংঘাতের দিকে চলে গেছে। আর সেই সংঘাতের মাঝে রয়েছে কাশ্মীর।’
ঘাসে ঢাকা নদীর তীরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলেন ২১ বছর বয়সী কম্পিউটার প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবরার। তার একটি ভালো চাকরি আছে। কাজেই তিনি কিছুটা আশাবাদী মানুষ।
তার পরও তিনি বলেন, আতঙ্কে শহরে সপ্তাহখানেক রাতে ঘুমাতে পারিনি। শ্রীনগরের রাস্তায় এই প্রথমবারের মতো আমি উত্তেজনা টের পেলাম।
কিছুদিন আগে কাশ্মীরের শ্রীনগরে তার বাড়ির ওপর দিয়ে প্রথম যখন যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছিল, তার কিছুক্ষণ পর ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইউসুফ জানতে পারেন, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ১০ কিলোমিটারের কম দূরত্বের একটি স্কুলে গণিত পড়ান মোহাম্মদ ইউসুফ। মাথার ওপরে যুদ্ধবিমানের গর্জন এর আগে কখনও তিনি শুনেননি বলে জানিয়েছেন।-খবর ইন্ডিপেন্ডেন্ট অনলাইনের
যুদ্ধবিমানের গর্জন যখন ইউসুফের কানে আসে, তখন রাত সোয়া ৩টার বেশি বাজে। তখনও কেউ জানতেন না যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের ভূমিতে বিমান হামলা চালাতে যাচ্ছে।
ইউসুফ বলেন, বিমানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আতঙ্কিত হয়ে সবাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি।
স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদ ইউসুফের সংসার। তিনি বলেন, কী ঘটছে, তা দেখতে সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গভীর রাত, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি। তবে বিমানের বিকট গর্জন এসে কানে লাগছিল।
এই গণিত শিক্ষক বলেন, আমি কখনেই এমন শব্দ শুনিনি। কিন্তু এটি কীসের শব্দ তা জানতাম। আমরা ভেবেছিলাম, সীমান্তে কিছু একটা ঘটছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
কেবল মোহাম্মদ ইউসুফই নন, শ্রীনগরের অন্য বাসিন্দারাও নিজেদের সন্তানদের আতঙ্ক থেকে বাঁচাতে মিথ্যা বুঝ দিয়েছেন। যাতে খারাপ কিছু ঘটছে বলে তাদের কাছে মনে না হয়। শিশুরা যাতে স্বাভাবিক থাকতে পারে।
তিনি তার ১০ বছর বয়সী ছোট ছেলে আজহারকে বলেন, সব কিছু ঠিক আছে। এটি বিমানের স্বাভাবিক চলাচল।
সশস্ত্র পুলিশের বিপুল অবস্থান সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হচ্ছে কাশ্মীর। ডাল লেকের চোখ জুড়ানো দৃশ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে সেখানে।
৪০০ বছরের পুরনো মোগল আমলের পরীমহল দেখতে পর্যটকরা ছুটে যান কাশ্মীরে। কিন্তু পরীর নিবাসখ্যাত এই গার্ডেনেও ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর একটি ছোট্ট ক্যাম্প বসানো রয়েছে।
১৪ ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় হামলার পর কাশ্মীরে উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ঝিলাম নদে যাত্রী পারাপার করেন আবদুল কারিম কালু। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সর্বশেষ শ্রীনগরে যুদ্ধবিমানের ঘুরপাক দেখেছেন তিনি।
কালু বলেন, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিমান দেখার পর সেই সময়ের কথা আমার মনে পড়ে গেছে। এখানে ব্যবসায়ী সমিতি নিয়মিত ধর্মঘট ডাকে। কাজেই শহরজুড়ে সবসময় উত্তেজনা থাকে।
আর এসব কারণে কালুর উপার্জনেও ধাক্কা লাগে। তিনি বলেন, বাস্তবিকভাবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সংঘাতের কারণে কাশ্মীরের লোকজনের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক কাজ করছে।
কালু সবসময় নিজের দুই নাতনির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। তিনি বলেন, যারা সকালে রুটি-রুজির সন্ধানে ঘর থেকে বের হন, সন্ধ্যায় তারা জীবিত ফিরতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
কাশ্মীরের রাস্তায় একসময় বহু হকার দেখা যেত। তারা হস্তশিল্প ও কাশ্মীরি কাপড়চোপড় বিক্রি করতেন। পর্যটকরা তা সংগ্রহ করছেন। কিন্তু পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সড়ক থেকে তারা উধাও হয়ে গেছেন।
কাশ্মীরের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এক দোকানির সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বিচলিত বোধ করেন।
কীভাবে পাক-ভারত সংঘাত তার ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে, সে কথা জানালেন ২৫ বছর বয়সী যুবক আবিদ খাপড়া।
কথা বলার সময় তার ভেতর খুবই আবেগ দেখা গেছে। বেদনার সঙ্গে তিনি জানান, দিনে দিনে আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমাদের শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। এভাবেই খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের।
গত সপ্তাহে যখন মাথার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখন এটিকে হলিউডের যুদ্ধ চলচ্চিত্রের দৃশ্য বলে মনে হয়েছিল। আমরা খুবই হতাশ। বাড়িতে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছি না।
পাকিস্তান শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতের কাছে ফেরত দেয়ার পর উত্তেজনা কিছুটা কমতির দিকে গেছে। কিন্তু এতে এমন কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি, যাতে কাশ্মীরের লোকজন আশাবাদী হতে পারেন।
এই কম্পিউটার প্রকৌশলী বলেন, এখানে কারও ভবিষ্যৎ নেই। কোনো শিশু, নারী-পুরুষ কিংবা বৃদ্ধ। কেউ নিরাপদ নয়, এমনকি এখানকার কোনো বাড়িতেও কারও নিরাপত্তা নেই।