পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ইংরেজি মাসে যেমন করে ইংরেজরা তাদের বছরের প্রথম দিনটিকে ঘিরে বর্ণিল আয়োজনে বর্ষকে বরণ করে। তার চেয়েও ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করা হয় বাংলা নববর্ষ। সারাদেশে এই নববর্ষকে বরণ করার জন্য নানা আয়োজন করে থাকে। প্রাণের এই উৎসবকে বরণ করতে পিছিয়ে নেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও।
নববর্ষকে বরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে নাচ, গান র্যালি, শোভাযাত্রা, হাতি ঘোড়া, ময়ুর প্রভৃতি তৈরি করা হয়। বাংলার যেসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে সেসব জিনিস নিয়ে র্যালি করেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীরা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক লুঙ্গিপরে, গরুর গাড়ি করে, বাঁশি, পুতুল নাচ, র্যালি করে।
এছাড়াও ছবি তোলার ফ্রেমসহ সারা ক্যাম্পাসে সাজানো হয়েছে কয়েক মিটার পর পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ।
নববর্ষকে স্বাগত জানাতে দিনব্যাপী উৎসবে মেতে ওঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রবিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টার দিকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসে মন মাতানো বাঁশির সুর আর গান। প্যারিস রোডে পৌঁছতেই দেখা গেল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
কিছু মুহূর্ত পরপরই একেকটি বিভাগ শোভাযাত্রা করছে। সেখানে কেউ ঢাক বাজাচ্ছেন, কেউ গাইছেন, কেউ আবার নাচছেন।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে দেখা হলো ডোমেন জোসেফ নামের এক অধ্যাপকের সঙ্গে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে পিএইচডি করছেন তিনি।
তিনি জানান, বাঙালির এই উৎসবকে দেখে তিনি অভিভূত। আমরা ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করি। কিন্তু বাংলা নববর্ষ উদযাপন ভঙ্গি সত্যিই খুব ভাল লাগছে। সবাই কত উল্লাস করছে। অনেকদিন হলো এ দেশে আছি। তাই আমিও এ উৎসবের রং গায়ে মাখার চেষ্টা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মত আরও প্রায় ত্রিশজন বিদেশি রয়েছেন যারা বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। উৎসব উদযাপনে তারাও পিছিয়ে ছিলেন না। সকাল থেকেই বিভাগের অনুষ্ঠানগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় তাদের।
এদিকে, নববর্ষকে বরণ করতে ক্যাম্পাস সেজেছে ভিন্ন সাজে। জায়গায় জায়গায় মঞ্চ। সেখানে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, অভিনয়, কৌতুক পরিবেশন করছেন শিক্ষার্থীরা। বাংলা, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ফাইন্যান্স বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগ ও চারুকলা অনুষদ আলাদাভাবে কর্মসূচির আয়োজন করে।
চারুকলা অনুষদ সকাল ৯টার দিকে হাতি, ময়ূর আর ঘোড়ার ডামি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করে। এই ডামিগুলো দেশের দ্রুত উন্নয়নের নির্দেশক বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। শোভাযাত্রায় উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্যদ্বয় অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ও অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াসহ সহস্রাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশ নেয়। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ভবন, রবীন্দ্র ভবন, মমতাজ উদ্দীন কলাভবন, স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন, বুদ্ধিজীবি স্মৃতিফলক চত্বর, পুরাতন ফোকলোর চত্বরসহ ক্যাম্পাসের প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই বিভিন্ন বিভাগের ছোট-বড় মঞ্চ। সেখানে শিক্ষার্থীরা বাউল, লোকসঙ্গীতসহ বিভিন্ন ধরনের বৈশাখী গান, কেউ আবার নৃত্য পরিবেশন করছেন। পুরাতন ফোকলোর চত্বরে বৈশাখ উপলক্ষে ফটোগ্রাফি করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোল্লা মো. সাঈদ, প্রণব কুমার রায় ও আমীরুল আজাদ।
তারা জানান, পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি তোলা তাদের শখ। এছাড়াও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় কেউ বৈশাখী পাঞ্জাবি, শাড়ি, গামছা, ফুল বিক্রির দোকান বসেছে। কেউ কেউ আবার সেলফি তুলছেন, কেউ আবার প্রিয়জনের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই নয়, রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মানুষ ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসেছেন। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মতিহারের এই সবুজ চত্বরটি। নগরীর সাগরপাড়া থেকে বন্ধুদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসেছেন কলেজ শিক্ষার্থী রিমা হাসনাইন। ফুলের তাজ মাথায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিবছরই এ দিনটিতে ক্যাম্পাসে আসা হয়। চারুকলার শোভাযাত্রাটি বেশ মনমুগ্ধকর। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় গান-বাজনা হচ্ছে। দিনটি খুবই উপভোগ করছি।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐক্যের উৎসব। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার উৎসব। উৎসব ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি ও বিগত দিনের অপ্রাপ্তির হিসাব মিটিয়ে ফেলার। নতুন এই বছরে পরস্পরের ভেদাভেদ ও দ্বন্দ্ব ভুলে বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে এই প্রত্যাশাই যেন প্রতিটি বাঙালির।