শ্রীলংকায় গির্জা ও হোটেলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত (এনটিজে) নামে একটি ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম আসার পর দেশটির মুসলিমরা নতুন এক অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। অনেকেই তাদের ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে।
২৬ বছর আগে শ্রীলংকার তামিল টাইগাররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করেছিল। ২০০৯ সালের সেই গৃহযুদ্ধ অবসানের এক দশক পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী এ হামলা ঘটল। গত বছরের মার্চেও কয়েকটি মসিজদ ও মুসলিমদের কয়েকটি দোকানে সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলায় একজন নিহত হয়েছিলেন।
রাজধানী কলম্বোতে মুসলিম সংগঠন ন্যাশনাল শূরা কাউন্সিলের কর্মকর্তা আজমান আবদুল্লাহ বিবিসিকে বলেন, আতঙ্কের চেয়ে মুসলিমরা ‘ক্ষুব্ধ, ব্যথিত’। আতঙ্ক যে একবারেই নেই তা বলব না। নানা ধরনের গুজবও শোনা যাচ্ছে। তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের খ্রিস্টান ভাইয়েরা বুঝতে পারছেন যে শ্রীলংকার মুসলিমরা কোনোভাবেই তাদের ক্ষতি চায় না।’
তিনি আরও জানান, ‘শীর্ষ মুসলিম নেতারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। হামলার তীব্র নিন্দা করে মসজিদে মসজিদে ব্যানার ঝুলানো হয়েছে। আবদুল্লাহ বলেন, ‘মুসলমান হিসেবে নয়, দেশের নাগরিক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
গত পাঁচ বছর ধরে ব্যবসার সূত্রে কলম্বোয় থাকেন বাংলাদেশের নাগরিক খালেকুজ্জামান সোহেল। সোমবার দুপুরে শহরের ওয়াল্লাওয়া এলাকায় এক মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে গিয়ে তিনি দেখতে পান ২০-২৫ জন সশস্ত্র পুলিশ মসজিদটি পাহারা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ভেতরে মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল তারা যতটা না আতঙ্কগ্রস্ত তার চেয়ে বেশি লজ্জিত এবং দুঃখিত। তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তাদের সম্প্রদায়ের কেউ দেশের ভেতরে এ ধরনের হামলা করতে পারে।’
শ্রীলংকার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং প্রায় ১০ শতাংশ মুসলিম। দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস এমনিতেই খুব ভালো না। গত বছর ক্যান্ডি এবং আশপাশের বেশ কিছু শহরে মসজিদ এবং মুসলিম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কট্টর বৌদ্ধদের হামলার পর সাময়িক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। রোববারের হামলার সঙ্গে মুসলিম একটি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কথা প্রকাশ হওয়ার পর স্বভাবতই অনেক মুসলিম উৎকণ্ঠায় পড়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানে শত শত মুসলিম লিখছেন, সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামের শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গলের সাংবাদিক ফারহান নিজামউদ্দিন বলেন, মুসলিমরা ক্ষুব্ধ এবং তারা হামলাকারীদের ‘সর্বোচ্চ সাজা’র দাবি করছেন।
গলের একজন মুসলিম লিখেছেন, ‘আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে, কিন্তু পড়াশোনা করেছি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে। ফলে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি আমার হৃদয়ের খুব কাছের।’ শ্রীলংকার নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য তুলে ধরে আরেকজন লিখেছেন, ‘শ্রীলংকায় দুটো গোষ্ঠী- একটি শ্রীলংকান এবং আরেকটি সন্ত্রাসী।’
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য মুসলিমদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। দেশটির টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হারিন ফার্নান্দো বলেছেন, ‘হামলাকারীরা দেশের সিংহভাগ মুসলিমের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমি তাদের মুসলিমই বলব না। এদেশের সাধারণ মুসলিমরা অত্যন্ত সজ্জন এবং অন্য সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তারা সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করেন।’
এদিকে শ্রীলংকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ায় দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানতে পারছে না দেশটির জনগণ। রোববার কয়েকটি চার্চ ও হোটেলে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলার পর দাঙ্গা ও সহিংসতা রোধে কয়েকটি মাধ্যম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। সহিংসতার আগের অভিজ্ঞতা থেকেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে জানানো হয়েছে। তবে এ পদক্ষেপে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছে জনগণ। গুরুত্বপূর্ণ খবর ও তথ্যের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে বলেও মনে করছেন তথ্য অধিকার কর্মীরা। খবর এএফপির।
বর্তমানে সারাবিশ্বেই তথ্য ও খবরাখবর জানার বড় উপায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এগুলোকে ব্যবহার করে ভুয়া খবর, ঘৃণা-বিদ্বেষ, ভয়-ভীতি ও সহিংসতা ছড়ানোর অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেই সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা, গত বছর শ্রীলংকার দাঙ্গা ও সহিংসতা উসকে দেয়া হয়। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে দেশে দেশে হতাশা ও অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। সেই অবিশ্বাস থেকেই রোববারের হামলার পর দ্বিতীয়বারের মতো বেশ কয়েকটি মাধ্যম বন্ধ করে দেয় শ্রীলংকা প্রশাসন।
তথ্য অধিকার সংগঠনগুলো নেটব্লকের তথ্য মতে, ইস্টার সানডের হামলার পর ফেসবুক, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের।
কয়েক বছর আগেও এ মাধ্যমগুলোকে তথ্য প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস মনে করা হতো। কিন্তু ভুয়া খবর, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে কুখ্যাতি কুড়িয়েছে এ মাধ্যমগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও এগুলোর ঝুঁকি ও হুমকি সম্পর্কে ওয়াহিবহাল। এ কারণেই সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে গুজব ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে।