অন্ধকারময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ওপর আলো ফেলে না বললেই চলে। কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে এই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্য সংখ্যা। তারা শরণার্থী হিসেবে আফগানিস্তান ও অন্যান্য দেশে নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছেন পাকিস্তানে। এরা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। দিনের বেলায় তাদের দেখা যায় না। কিন্তু রাত হলে বেরিয়ে পড়েন যৌনকর্মী হিসেবে।
তাদেরই একজন আফসুস আফগানি (৪০)। তিনি বলেছেন, আমার পিতা খুবই নিষ্ঠুর একজন মানুষ। তিনি আমাকে মেয়েদের মতো পোশাক পরতে দেখে মাঝে মাঝেই প্রহার করতেন। আমার মনে হয়, তিনি তালেবানদের ভয়ে ভীতু ছিলেন। কারণ, আমাকে পেলে তালেবানরা মেরে ফেলতো।
সাবেক সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে আফগানিস্তান থেকে পালিয়েছেন আফসুস আফগানি। তারপর থেকে জীবনের বেশির ভাগ সময় পাড় করেছেন পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখানে তিনি পরিচিত একজন নারী হিসেবে। এই পরিচয়েই তিনি সেখানে যৌনকর্মী হিসেবে জীবন বেছে নিয়েছেন। শুধু এই পেশোয়ারেই আফগানিস্তানের কয়েক হাজার ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া হিসেবে পরিচিত শরণার্থী অবস্থান করছেন। তারা শুধু কট্টরপন্থিদের চাপে আছেন এমন নয়। একই সঙ্গে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি রয়েছে। এর অর্থ হলো যদি তাদেরকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হয় তাহলে জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এ অঞ্চলে এ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতার স্বীকৃতি নেই। তাদের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই। তবে তাদের সংখ্যা কয়েক লাখ হবে। বেশির ভাগই পালিয়ে পাকিস্তানের আন্ডারগ্রাউন্ডে আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে সেখানে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। এমন সংখ্যার মধ্যে আফসুস আফগানি ছাড়াও আছেন ননী বেগম নামে এক হিজড়া। তিনি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক শরণার্থীর ২৮ বছর বয়সী সন্তান। ননী বেগম বলেন, জন্মের পর পিতামাতা আমাকে একটি নাম দিতে কার্পণ্য করেন নি। আমি যতদূর মনে করতে পারি মানুষ আমাকে শুধু ননী বেগম নামে ডাকতো। কিন্তু পরিবারের কাছে যখন আমি আমার ভিন্ন পরিচয়ের কথা তুলে ধরলাম, তারা আমাকে বাড়িতে আটকে রাখলো। এটা ঘটেছে এমন এক সময়ে যখন আমি পরিণত বয়সে। কেনাকাটা করতে আমার বড় ভাইদের সঙ্গে বাইরে যেতে দেয়া হতো না। খেলতে দেয়া হতো না। তাদের ভয় ছিল, যদি আমাকে বাইরে যেতে দেয়া হয় তাহলে পরিবারের মুখে কালিমা লেপন করবো।
২০০৭ সালে ননী বেগম তার পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। অন্য চারজনের সঙ্গে করাচিতে একটি বস্তিতে ওঠেন। সেখানে তাদেরকে দেখাশোনা করছিলেন একজন ‘গুরু সম্বল’। ননী বেগম দেখলেন তাদের সামনে যৌনকর্মী হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদেরকে প্রতিদিনের আয় এনে গুরুর কাছে জমা দিতে হতো। তিনি আমাদেরকে রাতের খাবার ও আশ্রয় দিতেন এর বিনিময়ে। এ সময় প্রতিটি দিন ছিল অবমাননাকর। প্রতিটি ক্লায়েন্ট বা নতুন খদ্দেরের কাছ থেকে নিতাম দুই ডলার বা তারও কম। মাঝে মাঝে আমাকে ওইসব খদ্দের তাদের বাসায় নিয়ে যেতেন, যেখানে তারা অনেকে অবস্থান করতেন।
ননী বেগম হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মাঝে মাঝেই তাদের বসবাসের স্থান পুলিশ তল্লাশি করতো। একসঙ্গে যদি তারা বাইরে যেতেন তাহলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হতো। যদি বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করা হয় তাহলেই পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দিতো। না হলে তারা মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্ক দাবি করতো। কারণ, পুলিশ জানে হিজড়া শরণার্থীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য কোনো আইন নেই পাকিস্তানে। তাই তারা যা পারে তাই করে এদের সঙ্গে।
মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলছেন, পাকিস্তানি নাগরিক এমন হিজড়া সম্প্রদায়কে পরিচিয়পত্র ও পাসপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে পাকিস্তানে। ফলে হিজড়াদের একটি ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়েছে। তারা কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, যাতে সমাজের কাঁধ থেকে বোঝা কমে। কিন্তু অভিবাসী বা শরণার্থী হিজড়াদের ক্ষেত্রে এমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। এসব অভিবাসী বা শরণার্থী হিজড়াদের বেশির ভাগই বসবাস করেন বিচ্ছিন্ন করে রাখা বস্তিতে। দশকের পর দশক ধরে তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। ননী বেগম বলেন, করাচিতে কয়েক শত বাঙালি হিজড়া রয়েছেন। তারা দিনে দ্বাররক্ষী আর রাতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে খুব সামান্য অর্থ আয় করেন। আমাদের কাছে যৌনকর্ম হলো এক টুকরো রুটি কেনার অর্থ যোগাড় করা। বাকিটা হলো কট্টরপন্থি সমাজের কারণে। এ সমাজে এ পেশা নিষিদ্ধ। যেকেউ আমাদেরকে গ্রেপ্তার করতে পারে।
পাকিস্তানে হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেকেই কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন। কিন্তু কেউ কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন। তাদের একজন হলেন পাকিস্তানি হিজড়া ২৮ বছর বয়সী কামি সিদ। তিনি নিজে একজন মডেল। পরিচালনা করেন অন্যদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করা যায় এমন একটি সমাজ। তিনি বলেন, পাকিস্তানের মতো দেশে হিজড়া সম্প্রদায়ের হয়ে মডেল হওয়া খুবই সাহসের বিষয়। আমার রগরগে ফটোশুটের কারণে মানুষ আমাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা বলেছে। আমি ইসলামিক নিয়ম ও সাংস্কৃতিক আদর্শ মেনে চলি। যারা সহিংসতায় থমকে আছেন তাদের কাছে আমি আলোকবর্তিকা। আমি তাদেরকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। বলছি, সামনে নতুন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
পাকিস্তানভিত্তিক হামরাজ সোসাইটির ৩৪ বছর বয়সী সুপরিচিত অধিকারকর্মী রাজা হায়দার তিরমিজি বলেন, আমাকে এ পথ থেকে ফিরতে মাঝে মাঝেই ফোনে হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু আমার প্রতিশ্রুতিই হলো আমার জীবনের মূল্য। প্রকাশ্য দিনের বেলা আমি হিজড়াদেরকে অপহরণের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। তারপর তাদেরকে মাদক পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধে ব্যবহার করা হয়। তাদের অঙ্গ ছেদ করে তা বিক্রি করা হয়।
(নিউ ইয়র্ক পোস্টে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)