ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যে আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা-রক্ষীদের কনভয়ের ওপরে, তাতে আদিল আহমেদ দার নামের এক যুবকের নাম জড়িয়ে গেছে। বলা হয়, বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে কনভয়ে ধাক্কা দিয়েছিলেন এই আদিল আহমেদ দারই। ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ৪০ জনেরও বেশী নিরাপত্তা কর্মী। মৃত্যু হয়েছিল আদিল আহমেদেরও।
কিন্তু তার পরিচয় জানা যায় হামলার বেশ কয়েক ঘন্টা পরে, যখন পাকিস্তান ভিত্তিক উগ্রপন্থী সংগঠন জৈশ-ই-মুহম্মদ একটি ভিডিও প্রকাশ করে।
আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে এত মানুষের প্রাণ নিতে চলেছে বলে আদিল আহমেদকে এতটুকুও চিন্তিত দেখায় নি ওই ভিডিওটিতে। তিনি জানিয়েছিলেন, ওই ভিডিওটা যখন প্রকাশিত হবে, ততক্ষণে তিনি জান্নাতে পৌঁছে গেছেন।
২০১৮ সালেই জৈশ-ই-মুহম্মদের যোগ দেন পুলওয়ামারই বাসিন্দা আদিল, সেখানেই বড় হয়েছিলেন তিনি। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পুলওয়ামা অনন্তনাগ লোকসভা আসনের অন্তর্গত এই আসনটিই ভারতের একমাত্র কেন্দ্র , যেখানে তিন দফায় ভোট নেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার কারণে।
আদিল আহমেদ হাইস্কুল অবধি পড়াশোনা করেছিলেন। গতবছর মার্চ মাসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আগে অবধি তিনি ছোটোখাটো কাজ করতেন। শান্তশিষ্ট আর বেশ লাজুক স্বভাবেরই ছেলে ছিলেন আদিল, এমনটাই বলছেন যারা তাকে চিনতেন, তারা।
তার পরিবার বলছে, বুরহানওয়ানি নামের জনপ্রিয় এক উগ্রপন্থী নেতার মৃত্যুর পরে যে বিক্ষোভ হচ্ছিল, সেই সময়ে চোট পান আদিল। তারপর থেকেই ভারতের ওপরে তার ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
আদিল আহমেদ সেই হাজার হাজার কাশ্মীরী যুবকদের একজন ছিল, যাদের জন্ম হয়েছে গুলি বন্দুকের আওয়াজের মধ্যে আর জীবন শেষও হল তারই মধ্যে।
১৯৮৯ সাল থেকে চলতে থাকা হিংসাত্মক ঘটনায় কাশ্মীরে এখনও পর্যন্ত ৭০ হাজারেরও বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে ভারতের কড়া অবস্থানের কারণেই কাশ্মীর উপত্যকার অনেক যুবক অন্য পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন।
এইসব কড়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ছিল ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ। যে বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও।
এই সময়েই ছররা গুলি সবথেকে বেশী ছোঁড়া হয় নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুক থেকে। ওই গুলি লেগে শত শত মানুষের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ভারত অবশ্য ওই প্রতিবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে।
পুলওয়ামারই বাসিন্দা ৬৮ বছর বয়সী আব্দুল আহমেদ বাটের কথায়, "৯০ সালের পরে জন্ম হয়েছে যেসব কাশ্মীরীর, তাদের কপালে কখনই শান্তি জোটে নি। এদের জন্ম হয়েছে কার্ফুর মধ্যে, মৃত্যুও হচ্ছে কার্ফুর মধ্যেই।"
তিনি আরও বলছিলেন যে ১৯৮৯ সালের আগের যে কাশ্মীরের কথা তার মনে আছে, তাকে যেন একটা স্বপ্ন বলে মনে হয় এখন। বর্তমান প্রজন্ম সেই সময়টা তো দেখেই নি কখনও।
২০০০ সাল থেকে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ ধীরে ধীরে কমছিল, কিন্তু ২০১৬ থেকে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর আবারও পুরোদমে শুরু হয়ে যায় তাদের রমরমা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১৫০ সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী মারা যায় আর দু'বছর পরে ২০১৮ সালে মারা যায় ২৩০ জন। বুরহান ওয়ানিকে ভারত সরকার উগ্রপন্থী বলে মনে করলেও স্থানীয়দের অনেকেই কাশ্মীরের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি বলে তাকে মনে করেন।
বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পরে যে বিক্ষোভ চলেছিল, সেই সময়েই নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি লাগে আদিল আহমেদ দারের পায়ে। তাকে প্রায় ১১ মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল।
তার বাবা গুলাম হাসান দারের কথায়, "ওই সময় হঠাৎই আদিল বদলে গেল। যে শান্ত, লাজুক ছেলে ছিল ও, সেটা যেন একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল। কিন্তু কোনওদিনই খোলাখুলি আলোচনা করে নি এগুলো নিয়ে।"
পায়ে গুলি লাগার পর থেকে আদিল নিজের সময়টা ধর্মীয় আচার-আচরণ, ইন্টারনেট আর বন্ধু - এই নিয়েই কাটাতেন। আর কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে ২০১৮ মার্চ মাসে তো তিনি বাড়ি ছেড়েই চলে যান।
কেউ কেউ বলেন, কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিমন্ডল নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিল আদিল।
আদিলের এক আত্মীয় আলতাফ বলছিলেন, "তার রাগ ছিল একদিকে যখন উগ্রপন্থীদের মুরগীর মতো মারা হচ্ছে, অন্যদিকে কোনও হতাহত হচ্ছে না কেউ।"
পুলওয়ামারই আরেক বাসিন্দা জিব্রান আহমেদ বলছিলেন, "উগ্রপন্থী তো আমাদের বাড়িতে তৈরি হয় না। থানা বা সেনা ছাউনিতে তৈরি হয়। ২০১৬ সালে পুলিশ যেসব যুবকদের গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের বেশীরভাগই এখন উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোতে নাম লিখিয়েছে। হয়তো তাদের মনে হয়েছে যে প্রতিদিন এভাবে অপমানিত, নির্যাতিত হওয়ার থেকে সেটাই ভাল পথ।"
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক সুশান্ত সারিন বলছেন, সমস্যাটার অন্যদিকটা হল হিংসাকে মহিমান্বিত করে তোলা হয় অনেক সময়ে।
"বেশীরভাগ সমাজে হিংসায় অংশ নেওয়া মানুষদের সমাজ ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু কাশ্মীরে ব্যাপারটা উল্টো। লোকে যখন পাথর ছুঁড়ছে, অস্ত্র তুলে নিচ্ছে, তখন কি সরকার চুপচাপ বসে থাকবে?" প্রশ্ন মি. সারিনের।
তবে কাশ্মীরের এক পুলিশ কর্মী, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, ভারত যে পদ্ধতি নিয়েছে, তা তো সফল হচ্ছে না দেখাই যাচ্ছে।
"আপনি একজন উগ্রপন্থীকে মারলেন তো আরও দু'জন উগ্রপন্থায় নাম লেখাতে তৈরি হয়ে গেল। রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে উগ্রপন্থীদের মেরে ফেলার ওপরে ইদানিং জোর দেওয়া হচ্ছে বেশী," বলছিলেন ওই পুলিশ কর্মী।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ অজয় সাহানীর মতে - "ভারতীয় জনতা পার্টি কাশ্মীর উপত্যকাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। গোটা ভারতের জন্য উপত্যকা যেন একটা শত্রু মনোভাবাপন্ন অঞ্চল। এটা একটা সফল নির্বাচনী রণনীতি হতে পারে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে একেবারেই ভুল স্ট্র্যাটেজি।"
ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান, জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখেন।
তিনি বলছিলেন, "কাশ্মীরে কতসংখ্যক তরুণ, যুবক উগ্রপন্থীদের দিকে চলে যাচ্ছেন? তার থেকেও অনেক বেশী কাশ্মীরী ছাত্রছাত্রী সারা ভারতের নানা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন। অনেক কাশ্মীরী খুব ভাল ফুটবল খেলছেন জাতীয় স্তরে বা নানা রাজ্যের দলগুলোতে।"
"জম্মু-কাশ্মীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি বলে আর্মির যে রেজিমেন্ট রয়েছে, সেখানে নতুন নিয়োগ হচ্ছে - বহু কাশ্মীরী বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, প্যারামিলিটারি ফোর্সগুলোতে যোগ দিচ্ছেন। এ দিকটা তো কেউ ভেবে দেখছেন না!"
আদিলের বাবা গুলাম হাসান দারও চান না তার ছেলের পথে অন্য কোনও তরুণ বা যুবক হাটুক।
"আমি তো জানতাম ছেলে আমার সব কথা মেনে চলে । কিন্তু সেই ছেলেই কী করে মানব বোমা হয়ে গেল, কিচুই বুঝতে পারলাম না," বলছিলেন আদিলের বাবা।