Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৯ শুক্রবার, মে ২০২৫ | ২৫ বৈশাখ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

নয়ন বন্ডের চেয়েও দুর্ধর্ষ মোহাম্মদপুরের ‘লাড়া দে’ আর ‘দেখে ল-চিনে ল’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ জুলাই ২০১৯, ০৬:২৮ PM
আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৯, ০৬:২৮ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


ঢাকায় মোহাম্মদপুরের দুটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি মোহাম্মদপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও অন্যটি মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ। তার পেছনের সড়কটি ছায়াঘেরা নির্জন এক মনোরম এলাকা। তবে এমন মনোরম নির্জন এলাকাকেও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে একশ্রেণির বখাটে। এই বখাটেদের উৎপাতের মধ্যেই আতঙ্কে বসবাস করছেন নিরীহ বাসিন্দারা।

নূরজাহান রোডের ওই এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, দেয়ালে দেয়ালে লেখা গ্যাংস্টার ‘লাড়া দে’ গ্রুপের লোগো ও স্লোগান। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বছর দুয়েক ধরে এই ‘লাড়া দে’ ও ‘দেখে ল-চিনে ল’, ‘কোপাইয়া দে’ নামে গ্যাং গ্রুপ মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তারা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করে। প্রায়ই হচ্ছে ছিনতাই। প্রকাশ্যেই মাদক গ্রহণ করার সাথে মাদকের ব্যবসাও করছে কেউ কেউ। ‘লাড়া দে মোহাম্মদপুর’ নামে ফেসবুক ও ইউটিউবে একটি গ্রুপও রয়েছে তাদের। ওই গ্রুপের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।

শুধু মোহাম্মদপুরের ওই গ্রুপই নয়, ঢাকার হাজারীবাগ ও গেণ্ডারিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘বাংলা’ ও ‘লাভলেট’ নামে আরো গ্যাং গ্রুপ। সম্প্রতি বরগুনায় আলোচিত নয়ন বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপের চেয়েও তারা দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর।

লাড়া দে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ‘লাড়া দে’ অর্থ বলতে তারা বোঝাচ্ছে ‘নাড়িয়ে দেওয়া’ বা ‘ঝাঁকুনি দেওয়া’। এই গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন তামিমুর রহমান মীম নামের এক তরুণ। তার বাবার নাম একরামুল। মীমের বাসা মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকায়। তবে মীম বর্তমানে নবোদয় হাউজিংয়ের লোহার গেট এলাকায় বসবাস করছেন। তার নামে মাদক ব্যবসা, ছিনতাইয়ের একাধিক অভিযোগ ও মামলা রয়েছে। বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরও ছাড়া পেয়েছেন মীম। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে রয়েছেন ফাহাদ, ফয়সাল, অপু, তপু রায়হান, আকাশ, রাব্বি হোসেন, অভিক শিকদার, মাহাদি তৌফিক আজিম ও নাহিদ হাসান শুভ। গত বছরের অক্টোবরে নূরজাহান রোডের এম-২৮ নম্বর বাসায় ঢুকে প্রায় আড়াই লাখ টাকার জিনিসপত্র লুটে নেন মীম ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় নূরজাহান হক নামে এক নারী ‘লাড়া দে’ গ্রুপের সদস্যদের নামে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। এছাড়া মাস তিনেক আগে নবোদয় হাউজিং এলাকায় হেরোইন ও ইয়াবা বিক্রির সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন মীম। এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি মামলা হয়।

ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পাওয়া যায়, নবোদয় হাউজিংয়ে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করছে একটি গ্রুপ। এরপর সেখানে অভিযান চালিয়ে মীমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলায় মীমসহ কয়েকজনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

এসব গ্রুপের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব জেনেও এলাকার পুলিশ নির্বিকার। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মোহাম্মদপুরের এক বখাটে কিশোরের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ করার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো পুলিশের কিছু সদস্য গ্যাং গ্রুপকে ব্যবহার করে অনৈতিক বাণিজ্য করছেন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে মোহাম্মদপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নূরজাহান রোডের একাধিক দেয়ালে বিশেষ কায়দায় বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের নাম লেখা রয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকি দিয়ে দেয়ালে লেখা বিভিন্ন গ্রুপের স্লোগান। এসব স্লোগান বলে দিচ্ছিল, গ্যাং গ্রুপের মধ্যে বিরোধ আর দ্বন্দ্ব কতটা প্রকট। নাম প্রকাশ না করে এলাকার এক বাসিন্দা জানালেন, দিনদুপুরে গাঁজাসহ নানা ধরনের নেশার আসর বসানো হয় নূরজাহান রোডে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশেই র‌্যাব-২-এর কার্যালয় থাকলেও গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা এসব তোয়াক্কা করছেন না। এছাড়া মোহাম্মদপুরে একাধিক খেলার মাঠ থাকলেও সেখানে কিশোর-তরুণরা খুব বেশি খেলতে যায় না। সেই তুলনায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বখাটেদের বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।

ফেসবুকে ‘অল কিং লাড়া দে’ নামে একটি স্লোগান সংবলিত পেজে ছবি রয়েছে। সেখানে দেড় শতাধিক কিশোর-তরুণকে হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই গ্রুপের আরেকটি স্লোগান হলো, ‘জাস্ট লাড়া দে অল মোহাম্মদপুর।’ তাদের সাংকেতিক চিহ্ন ‘পুতুলের মুখে লাভ সাইন’।

মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী হলেন কুলসুম আক্তার মনি ও তার স্বামী হাসান। সম্প্রতি এক হাজার হেরোইনের পুরিয়াসহ মনি ও তার স্বামী গ্রেপ্তার হন। মনির কাছ থেকে মাদক নিয়ে খুচরা বিক্রি করে আসছিলেন মীমসহ ‘লাড়া দে’ গ্রুপের সদস্যরা। মাদক বিক্রি ছাড়াও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিনব কৌশলে মানুষকে ফাঁসাচ্ছেন এই গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। কারো কাছে মাদক বিক্রি করে মীম ও তার সহযোগীরা পুলিশের অসাধু কয়েকজন সদস্যকে ফোন করে জানিয়ে দেন। এরপর তারা গিয়ে মাদকসহ ওই ব্যক্তিকে আটকের পর টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে মামলায় চালান দেওয়ার ভয় দেখান। অনেকেই ভয়ে ঘুষ দিয়ে রক্ষা পান। আবার ফাঁকা বাসায় কোনো মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে নিলে ‘লাড়া দে’ গ্যাংয়ের সদস্যরা পুলিশে জানিয়ে দেন। এরপর পুলিশ সেখানে হাজির হয়ে অনৈতিক বাণিজ্যে জড়ায়।

অভিযোগ রয়েছে, মীম ও তার গ্রুপকে এ ধরনের কাজে সহায়তা দিয়ে আসছেন মোহাম্মদপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মেজবা উদ্দিন ও এএসআই মো. শামীম আকন্দ। এছাড়া মীমের ফেসবুক পেজে আদাবর থানার এসআই প্রদীপ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে, যা দেখে যে কারো মনে হবে মীমের সঙ্গে এসআই প্রদীপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার তৈরি করেছেন মীম। সেই পোস্টারের ছবি মীমের ফেসবুকেও আছে।

এ বিষয়ে এএসআই শামীম আকন্দ বলেন, ‘মীমের সঙ্গে তার কোনো সখ্য নেই। তবে মাঝে মধ্যে তিনি ফাঁড়িতে এলে একসঙ্গে চা-সিগারেট খান- এতটুকুই। এসআই মেজবা স্যারের সঙ্গে মীমের ‘ভাই ভাই’ সম্পর্ক।’

আদাবর থানার এসআই প্রদীপ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘মীম খারাপ ছেলে। তাকে ২-৩ বার আমি ধরেছি।’ একসঙ্গে ছবি তোলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রদীপ জানালেন, ‘২০১৭ সালের আগে তিনি মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত থাকাকালে হয়তো মনের অজান্তে ছবি তুলে ফেলেছেন।’ তবে এ ব্যাপারে জানতে কাউন্সিলর রাজীবের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপপরিচালক মেজর রইসুল ইসলাম মনি বলেন, গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড় ধরনের ক্রাইমে জড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে সংশ্নিষ্ট থানার কিশোর অপরাধী হিসেবে অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে অনেক মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। অপরাধী তালিকাভুক্ত হওয়ায় সরকারি চাকরি পেতেও সমস্যা দেখা দেয়। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়া দরকার।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, যাতে গ্যাং গ্রুপ গড়ে ওঠার আগেই বখাটে কিশোরদের শনাক্ত করা যায়, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ডেকে সন্তানদের অপকর্মের কথা জানিয়ে ব্যবস্থা নিতেও বলা হচ্ছে।

Bootstrap Image Preview