Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৫ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

স্বপ্নপুরীতে ব্যাচেলরদের গল্পকথা

তানজীম শহীদ শান্ত
প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:০৬ PM
আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:০৬ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় স্বপ্নপূরণের নগরী। প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই স্বপ্নপুরীতে প্রতিদিন সহস্র নতুন মানুষের পদচারণায় মুখর হয় এই নগরীর রাজপথ। কেউ আসে জীবিকার তাগিদে তো কেউবা স্বপ্ন পূরণের বুক ভরা আশা নিয়ে।

এছাড়াও, এক শ্রেণির মানুষের আগমন ঘটে যাদের উদ্দেশ্য জীবিকা নির্বাহ অথবা স্বপ্নপূরণ কোনটি নয়। পরিবার পরিজনের মায়া ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্য একটাই ‘উন্নত শিক্ষা’। আর উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আসা এই শিক্ষার্থীদেরকে যে নামে ধরে সম্বোধন করা হয় তার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ‘ব্যাচেলর’- খুব পরিচিত একটি শব্দ আমাদের কাছে।

বাবা-মায়ের ছায়াতল থেকে বহুদূরের এই ব্যস্ত নগরী ঢাকায় টিকে থাকাটা কিন্তু একদম সহজ নয়। অনেকে খরচের জন্য পরিবারের উপর নির্ভরশীল থাকলেও সবাই কিন্তু এক নয়। ইট পাথরের এই রঙিন শহরে হাজারো মানুষের ভিড়ে এখনও অনেকেই রয়েছে যারা লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। চলুন দেখি এমনই দুটি গল্প।                                                                                        

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্র কাজল, মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। প্রায় ৭ বছর ধরে এসএম হলের ১২০ নাম্বার কক্ষে ওর বসবাস। বিগত ৪ বছর ধরে ওকে দেখে আসছি দিব্যি নিজের খরচ নিজেই চালাচ্ছে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি দুটি টিউশন পড়ায় কাজল। মাস শেষে আট হাজারের মত টাকা হাতে পায়। পরিবারের টানাটানির কারণে চার হাজারের মত টাকা বাসায় পাঠায় প্রতিমাসে। হাতে থাকে মাত্র চার হাজার। কিন্ত চার হাজার কি যথেষ্ট ঢাকা শহরে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য? কাজলের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম একেবারেই সম্ভব না। যদিও আবাসিক হলে থাকাটা বাইরের থেকে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, কিন্তু তারপরেও মাস শেষে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলা যেন এক রকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

একদিনের ঘটনা বলি। ভার্সিটি থেকে এসে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ কাজলের ফোন। মনে মনে ভাবলাম, টাকা ধার চাওয়া ছাড়া তো কোনদিন ফোন দাও না। ফোন ধরার পর যা বুঝলাম, আমার ধারণা ভুল। টাকা চাওয়ার জন্য আজ কাজল ফোন দেয়নি। ফোন ধরার পর বলল, “দোস্ত আজ রাতে তোর বাসায় থাকায় যাবে?” আমি বললাম চলে আসতে। আসার পরে দেখলাম ওর মুখ শুকিয়ে আছে। মোটাসোটা শরীরে মুখ শুকিয়ে থাকলে দেখতে কেমন লাগে! জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। কাজল বলতে চায় না। অনেক আকুতি মিনতির পরে ওর পেট থেকে কথা বের হল। যা ছিল, “দোস্ত আজ মাসের ১২ তারিখ, কিন্তু এখনও বেতন পাই নাই। পকেটে একটা টাকাও নাই। ৪-৫ জন টাকা পায় আমার কাছে। টাকা নাই দেখে আজ দুপুরে খাই নাই। তাই চলে আসছি তোর বাসায়।”

এরপর কাজল আমার বাসায় দুইদিন ছিল। আমিই জোর করে রেখে দিয়েছিলাম ওকে। বলেছিলাম যতদিন টিউশনের বেতন না পায় ততদিন যেন আমার বাসায়ই থাকে। কাজল থেকেছিলও। দুইদিনের মাথায় বেতন পাওয়ার পর সবার আগে আমাকে নিয়ে পুরান ঢাকায় গিয়েছিল; হাজির বিরিয়ানি খাওয়াবে বলে।   

এবার আরেকজনের গল্প বলা যাক। এই ভদ্রলোকের নাম অভিজিত। সে সম্পর্কে আমার বন্ধু, নামে ছাত্র আর পেশায় ফ্রিল্যান্সার। বিষয়টা হয়ত সবার কাছে অবাক লাগবে যে নামে ছাত্র কথাটার মানে আবার কি। তবে শুরু থেকেই বলা যাক। সময়টা ২০১৫ সাল; অভিজিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হল। ঢাকায় নিজের খরচ চালাতে যখন অভিজিত হিমশিম খাচ্ছিল তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় স্বনির্ভর হওয়ার; ওয়েব ডিজাইনিংয়ের কোর্স করে শুরু করল ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। শুরুতে কাজ পেতে কিছুটা বেগ পেতে হলেও দক্ষতা আর একাগ্রতার জোরে ধীরে ধীরে কাজ পেতে শুরু করে। এক সময় ওর আয় এত বেশি বেড়ে গেল যে শুধুমাত্র নিজের থাকার খরচই নয়, বরং নিজের ভার্সিটির খরচও দিব্যি নিজেই জোগাড় করতে সক্ষম হয়ে যায়। ভাবছেন এটা তো খুবই ভাল গল্প। কিন্তু গল্পের আসল মোড় তো এখন ঘুরবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিয়মিত হওয়ার কারণে এটা অভিজিতের পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে যেটা এক সময় গিয়ে ওর পড়ালেখায় প্রভাব ফেলতে শুরু করল। একবার অভিজিত এক সাবজেক্টে ফেইল করল। এরপর বেচারা পরল দ্বিধাদ্বন্দে। পড়াশোনা নাকি ক্যারিয়ার- কোনটাকে প্রাধান্য দিবে? শেষমেশ ক্যারিয়ারের মায়াজালে পরে অভিজিত সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে ফেলল! এভাবেই চলছে বিগত দুই বছর; দুই সেমিস্টার পড়ে তো এক সেমিস্টার ড্রপ দেয়। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় আয়-উপার্জন ভাল হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করাটা কোনভাবেই হয়ে উঠছে না অভিজিতের।

এভাবেই পড়াশোনার পাশাপাশি হয়ত টিউশন পড়িয়ে, নয়ত পার্ট টাইম চাকরি করে নিজের খরচ চালানোর চেষ্টায় ব্রত হাজারো তরুণ-তরুণী। কেউ প্রতিনিয়ত বন্ধুদের কাছে ধার দেনায় নিমগ্ন থাকাটা কেউ নিজের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে; কেউবা উপার্জনের চিন্তায় নিজের একাডেমিক লাইফকে বিসর্জন দিতে বসেছে।

সহস্র গল্পের ভিড়ে হয়তবা এদের গল্পগুলো সবার সামনে উঠে আসে না। এই দুটো শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করলাম মাত্র। এমন অনেক হাজারো সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে এই স্বপ্ননগরীতে। সময় হলে হয়ত আরেকদিন বলব আরও কিছু সংগ্রামী তরুণদের গল্প।

Bootstrap Image Preview