Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ মঙ্গলবার, মে ২০২৫ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

আমেরিকাকে মরণকামড় দেবে ইরান!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ জানুয়ারী ২০২০, ০৯:০৩ PM
আপডেট: ০৪ জানুয়ারী ২০২০, ০৯:০৩ PM

bdmorning Image Preview


বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহত হবার পর প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে বাগদাদ।

শুক্রবার টুইটারে দেয়া এক শোকবার্তায় দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি বলেন, জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার ঘটনায় আমেরিকার জন্য ‘ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ’ অপেক্ষা করছে।

এই ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ বলতে অবশ্যই সামরিক লড়াইয়ের কথাই বুঝিয়েছেন ওই নেতা। কেবল তিনি নন, আরো বেশ কয়েকজন ইরানি নেতাও যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এই হত্যার ঘটনায় বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ারও আশঙ্কা করছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকার মতো সামরিকভাবে শক্তিধর দেশের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো ক্ষমতা ইরানের আছে কি? থাকলেও তা কতটা? মার্কিন সেনাদের সঙ্গে লড়াই শুরু হলে কতদিন ধরে টিকে থাকতে পারবে ইরানের সামরিক বাহিনী? এখানে আমরা সেই বিষয়টি বিশ্লেষনের চেষ্টা করবো।

ইরানের সেনাবাহিনী

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মতে প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার সক্রিয় সদস্য আছে দেশটির সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার নিয়মিত সেনা আর কমপক্ষে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার ইসলামিক রিভলিউশানারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি।

এছাড়া আরও বিশ হাজার আছে আইআরজিসির নৌ বাহিনীতে। এরা হরমুজ প্রণালিতে আর্মড পেট্রল বোট পরিচালনা করে। আইআরজিসি বাসিজ ইউনিটও নিয়ন্ত্রণ করে যারা মূলত স্বেচ্ছাসেবী ফোর্স। মূলত অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ মোকাবেলায় তারা কাজ করে। এরা দ্রুত হাজার হাজার মানুষকে জমায়েত করতে পারে। আইআরজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ৪০ বছর আগে যা পরে বড় মিলিটারি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এটাকে ইরানর সবচেয়ে প্রভাবশালী ফোর্স বলে মনে করা হয়।

দেশের বাইরে অভিযান

কুদস বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি। এই বাহিনী বিদেশে অনেক গোপন অভিযান পরিচালনা করে এবং তারা সরাসরি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছে জবাবদিহি করে। এই ইউনিটকেই সিরিয়াতে মোতায়েন করা হয়েছিলো যারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়াদের সাথে একসাথে যুদ্ধ করেছে।

ইরাকে তারা শিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি প্যারা মিলিটারি ফোর্সকে সমর্থন করতো যারা ইসলামিক স্টেট গ্রুপের পরাজয়ে সহায়তা করেছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলছে কুদস ফোর্স অর্থ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও উপকরণ দিয়েছে এমন সংগঠনকে যাদের যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে মনে করে। এর মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন এবং প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদও রয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যা ও অবরোধ ইরানের অস্ত্র আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

দেশটির প্রতিরক্ষা খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে তা সৌদির আরবের মোট সামরিক আমদানির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মাত্র। ইরান সামরিক খাতে বেশি আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। এবং এরপরেই আছে চীন।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মতে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড়, বিশেষ করে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।

তারা আরও বলছে, ইরান স্পেস টেকনোলজি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে যাতে করে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা যায়।

তবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ইরান স্থগিত করেছিলো ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির পর, বলছে রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট। তবে তারা এও বলছে যে এটি আবার শুরু হয়ে যেতে পারে ওই চুক্তির অনিশ্চয়তার কারণে।

অনেক ক্ষেত্রেই সৌদি আরব ও উপসাগরীয় এলাকার অনেক টার্গেট ইরানের স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আওতাতেই আছে,বিশেষ করে ইসরায়েলে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুগুলো।

এছাড়া আরও প্রমাণ আছে যে তেহরানের আঞ্চলিক মিত্ররাও ইরানের সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও গাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে বিশেষ করে সৌদি আরব, ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের টার্গেটগুলোর ক্ষেত্রে।

গত বছর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে মধ্যপ্রাচ্যে যা ইরানের সাথে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।

ইরানের নন কনভেনশনাল অস্ত্র

কয়েক বছরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার ড্রোন সক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ২০১৬ সাল থেকেই ইরাকে ড্রোন ব্যবহার করে ইরান। ২০১৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোনকে ভূপাতিত করে তারা এই অভিযোগে যে ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

এর বাইরে তারা ড্রোন প্রযুক্তি তাদের মিত্রদের কাছেও স্থানান্তর বা বিক্রিও করেছে, বলছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সংবাদদাতা জোনাথন মার্কাস।

২০১৯ সালেই ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র আঘাত হেনেছিলো সৌদি তেল ক্ষেত্রে। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র এজন্য ইরানকেই দায়ী করেছিলো। যদিও তেহরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। বরং তারা ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের দায় স্বীকারের দিকে ইঙ্গিত করেছে।

ইরানের সাইবার সক্ষমতা

২০১০ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর বড় ধরনের সাইবার অ্যাটাকের পর তারা সাইবার স্পেস সক্ষমতায় জোর দেয়। আইআরজিসিরি নিজস্ব সাইবার কমান্ড আছে বলে মনে করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে বলেছে ইরান অ্যারোস্পেস কোম্পানি, প্রতিরক্ষা ঠিকাদার, এনার্জি ও ন্যাচারাল রিসোর্সেস কোম্পানি ও টেলিকম ফার্মগুলোকে তাদের বিশ্বব্যাপী সাইবার অপারেশনের কাজে টার্গেট করেছে।

২০১৯ সালে মাইক্রোসফট জানায়, ইরানভিত্তিক একটি হ্যাকার গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকে টার্গেট করেছিলো ও তারা আমেরিকা সরকারের অ্যাকাউন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেছিলো।

তাহলে দেখা যাচ্ছে পরোক্ষ সমরে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে টেক্কা দেয়ার ক্ষমতা ইরানি বাহিনীর অনেক কম। তবে পরোক্ষভাবে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ সৌদি আরব ও ইসরায়েলকে প্রায়ই টার্গেট করে থাকে তেহরান। আগেই বলেছি গত বছর সৌদি তেলক্ষেত্র আরামকোতে ভয়াবহ হামলা করেছিলো তেহরান, যদিও তারা এর দায় স্বীকার করেনি। একই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, ইরাক ও সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ দুটিতেও বড় রকমের প্রভাব রয়েছে ইরান সরকারের। ইরান ও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তার কারণে ইরানের বশির আল আসাদের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মার্কিন প্রচেষ্টা সফল হয়নি। বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ই সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েও সেখান থেকে পিছিয়ে আসেন। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সমস্ত মার্কিন সেনাকে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।

কাজেই দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে তেহরান এবং বিষয়টিকে অবহেলা করার কোনো কারণ নেই। যে কারণে চিন্তায় আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দুই মিত্র সৌদি আরব ও ইসরায়েল। আর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু হলে তাতে কেবল ইরানই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই, এই আগুনের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্ব জুড়ে। তাই অনেক পর্যবেক্ষক ইরানি কমান্ডার সোলেইমানি হত্যার ঘটনায় আমেরিকার সমালোচনা করে বলছেন, ট্রাম্প আগুন নিয়ে খেলছেন। যে আগুনে তিনি একাই পুড়বে এমন নয়, পুড়বে গোটা বিশ্ব।

এর চাইতেও বড় কথা ইরানের তো হারানোর কিছু নয়। এমনিতেই তো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই বিবর্ণ। তাই তারা যদি আমেরিকার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে সেটা হবে মরণকামড়।

Bootstrap Image Preview