মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট, ইরানের ছোঁড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ঠেকাতে পারেনি বলে দাবি করেছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)।আইআরজিসির দাবি, তাদের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রই মার্কিন ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে।
ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার বদলা নিতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সামরিক ঘাঁটি- ইরবিল ও আল-আসাদ বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইরান। বুধবার ওই দুটি ঘাঁটিতে প্রায় ২২টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরানি বাহিনী।
ইরানের এই মিসাইল হামলায় অন্তত ৮০ জন মার্কিন সেনা নিহত এবং আরও ২০০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইরান। এছাড়া হামলায় মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থিত জঙ্গিবিমান, ড্রোন ও হেলিকপ্টারসহ সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ইরানের সামরিক শক্তির অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে ধরা হয় দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে। এবার পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে নিজেদের সেই শক্তির জানান দিলো তেহরান।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনও এক বিবৃতিতে হামলার কথা জানায়। ইরানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের কোন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মতে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড়; বিশেষ করে স্বল্প পাল্লা আর মাঝারি পাল্লার। এসব ক্ষেপণাস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই সৌদি আরব ও উপসাগরীয় এলাকার অনেক ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম। পেন্টাগনের দাবি, গেলে কয়েক বছর ধরেই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে ইরান।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামরিক শক্তিতে ইরানের অবস্থান ১৪তম। মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির অবস্থান খুবই শক্ত। তাই সামরিক শক্তিতে শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে একহাত নেয়ার ক্ষমতা আছে ইরানের।
তবে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় ইরান নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পর বিশ্বের চতুর্থ শক্তি বলে দাবি করছে।
ইরানিয়ান বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) কলেজের ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা জেনারেল নুরুল্লাহি গত মাসে বলেছিলেন, ইরান প্রতিদিন ২০ হাজার মিসাইল উৎক্ষেপণে সক্ষম। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ২১টি মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তাক করা আছে।
তিনি আরো বলেন, ইরানের সক্ষমতা আসলে আরও অনেক বেশি। যুদ্ধ বেধে গেলে দৈনিক এর চেয়েও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম আমরা। সবচেয়ে বড় শত্রুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের জন্য ইরান প্রস্তুত।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার:
সাহাব-১: ৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম।
সাহাব-২: ৫০০ মাইল দূরের লক্ষ্যে হামলা চালাতে সক্ষম।
কিয়াম-১: ৭৫০ মাইল পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা। হামলা চালাতে পারে তুরস্কের লক্ষ্যবস্তুতে।
ফাতেহ-১১০: অতিক্রম করতে পারে ৩শ’ থেকে ৫শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব।
জোলফাগার: ইরানের অস্ত্রসম্ভারে থাকা এই ক্ষেপণাস্ত্রটি অতিক্রম করতে পারে ৭শ’ কিলোমিটার দূরত্ব।
সাহাব-৩: পাড়ি দিতে পারে ২ হাজার কিলোমিটার। এই দূরত্বে রয়েছে রাশিয়া, চীন, মিশর ও ভারতের মতো দেশ।
এক নজরে ইরানের সামরিক শক্তি-
সেনাবাহিনী:
ইরানের সেনাবাহিনীতে ৫ লাখেরও বেশি সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) দেড় লাখ সদস্য। ইরানে ইসলামী নিয়ম বজায় রাখতে ৪০ বছর আগে আইআরজিসি তৈরি করা হয়। এটি এখন দেশটির প্রধান সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা।
নিহত জেনারেল সোলাইমানির নেতৃত্বাধীন কুদস ফোর্স আইআরজিসির হয়ে বিদেশে গোপন অভিযান পরিচালনা করতো এবং সরাসরি ইরানের সুপ্রিম লিডারের কাছে রিপোর্ট করতো।
দেশটির সেনাবাহিনীতে ট্যাংক সংখ্যা ১,৬৩৪। সাঁজোয়া যানের সংখ্যা ২,৩৪৫।সেনাসদস্যের ব্যবহারের জন্য কামান রয়েছে ২,১২৮টি। পাশাপাশি ৫৭০টি সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি (স্বয়ংক্রিয় কামান) এবং এক হাজার ৯০০টি রকেটচালিত কামান রয়েছে।এছাড়া দেশটির সামরিক প্রশিক্ষিত জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৬ লাখ ১৯ হাজারের বেশি।
বিমানবাহিনী:
ইরানের বিমানবাহিনীতে ৫০৯টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে - ফাইটার বিমান ১৪২টি, অ্যাটাক বিমান ১৬৫টি, হেলিকপ্টার ১২৬টি ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার ১২টি।
পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য ১০৪টি ও পরিবহনের জন্য ৯৮টি উড়োজাহাজ রয়েছে তাদের। তবে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত কোনো স্টেলথ ফাইটার বিমান নেই তাদের।
নৌবাহিনী:
ইরানের নৌবাহিনীতে কোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নেই। তাদের ফ্রিগেট রয়েছে ছয়টি, করভেট রয়েছে তিনটি এবং ৩৪টির মতো সাবমেরিন রয়েছে। ইরানের ৮৮টি পেট্রোলবোট ও তিনটি মাইন ওয়্যাফেয়ার রয়েছে। এই বাহিনীতে কোনো ডেস্ট্রয়ার নেই।
দেশের বাইরে সফল অভিযান:
ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বাহিনী বলা হয় বিপ্লবী গার্ডসকে। এ বাহিনীর বিদেশি অভিযানের দায়িত্বে রয়েছে আল-কুদস ফোর্স, যার প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি।
মূলত আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না কুদস ফোর্সকে। বিদ্রোহীদের হাত থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদকে সুরক্ষায় সেখানে এ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
এছাড়া ইরাকে শিয়া নিয়ন্ত্রিত আধা সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে আসছে কুদস ফোর্স। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে ইরাকের এসব বাহিনী।
ইরানের প্রতিরক্ষা খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে, তা সৌদির আরবের মোট সামরিক আমদানির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মাত্র।
ইরানিরা সামরিক খাতে বেশি আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। এরপরে তাদের আমদানির তালিকায় দ্বিতীয় রয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মতে, দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড়। বিশেষ করে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।
ড্রোন সক্ষমতা:
কয়েক বছরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার ড্রোন সক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে। ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ২০১৬ সাল থেকেই ইরাকে ড্রোন ব্যবহার করে ইরান। ২০১৯ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোনকে ভূপাতিত করে ইরান। মিত্রদের কাছে ড্রোন প্রযুক্তি স্থানান্তর বা বিক্রিও করেছে ইরান।
২০১৯ সালেই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছিল সৌদি তেল ক্ষেত্রে। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র এজন্য ইরানকেই দায়ী করেছিল। যদিও তেহরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
সূত্র: বিবিসি