হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে তার সেই নারীসঙ্গী জান্নাত আরা ঝর্ণার একটি ফোনালাপে। সোনারগাঁওয়ের স্থানীয় এক হেফাজত নেতার সঙ্গে ঘটনার দুই দিন পর প্রায় আট মিনিট ১১ সেকেন্ড কথা বলেন ঝর্ণা। ঘটনার দিন স্থানীয় জনতা তাদের ঘেরাও করার সময় কে কী বলেছিলেন এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহও উঠে এসেছে তাদের কথোপকথনে।
আলাপে ঝর্ণা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, মামুনুল হক কারও কারও কাছে তাকে না চেনার বিষয়ে বলেছেন। এতে তিনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন।
আলাপে মামলা করা প্রসঙ্গে ওই নারী বলেন, ‘আচ্ছা কীসের জন্য মামলা করবেন? এইটা মিটাবে কীভাবে? এটা তো সরকার, থানাতে গেলে তো ডকুমেন্ট চাইবে। তখন কীভাবে কী করবেন?’
নামের বিষয়ে জান্নাত আরা ঝর্ণা ওই হেফাজত নেতাকে বলেন, ‘এই বিষয়টা আমি ভালো করে আপনাকে ক্লিয়ার করতেছি। যেটা হচ্ছে যে হুজুর যখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আসছিল, যখন হুজুর প্রথম... একদম প্রথম দফা তারা যখন জেরা করতেছিল, তখন সে বলছে আমার স্ত্রীর নাম হচ্ছে আমেনা তৈয়বা। ঠিক আছে। তারপর যখন তারা চলে গেল, টিএনও সাহেব আসলো, এসআই আসলো, সাংবাদিকদের সবগুলারে বের করে দিল, তখন আমি শুনতেছিলাম যে হুজুর বলছে যে এটা আমার সেকেন্ড ওয়াইফ। আমি বিয়ে করেছি আমি কোনো অবৈধ কিছু করি নাই। যখন তিনি সেকেন্ড ওয়াইফ বলছে তারপর আমাকে জেরা করা হইছে। এখন আমি কীভাবে ফেইক বলি। আমি তো তার বাবার নাম জানি না। আমি কী করে কী বলব, বলেন? আমাকে তো আলাদা জেরা করছে। এটা নিয়ে লাস্টে কী...’
বোরকার রং নিয়ে যে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রসঙ্গে মামুনুল হকের সেই নারীসঙ্গী বলেন, ‘ব্লু কালারের ওপরের খিমারটা (হিজাব) ছিল, নিচের কালারটা ছিল কালো কালার। এইটা লাস্টে কী হইতে পারে? আপনার কী ধারণা হচ্ছে?’
উত্তরে সেই হেফাজত নেতা বলেন, ‘আমাদের ধারণা এখন মানে আমার যেইটা এখন... এগুলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলেই আরও বেশি সমস্যা। হুজুরে এখন আসবে শুনছি, আমি যেভাবে পারছি যে হুজুর এই মুহূর্তে সোনারগাঁও না আসাটা ভালো। আসার দরকার নাই। যতটুকু হইছে হইছেই। কারণ এখানে ক্ষয়ক্ষতি তো কম হয় নাই। কারণ জিনিসটা আরও বাড়বে। মানে প্রশাসনের সঙ্গে আমরা যুদ্ধ কইরা এই মুহূর্তে পারব না। যতটুকু করছি ততটুকুই আল্লাহ উদ্ধার করতে পারছে দুই জনকে। এইটাই বেটার ছিল।’
কথোপকথনে জান্নাত আরা ঝর্ণা ওই হেফাজত নেতাকে বলেন, ‘আপনারা যা বলতেছেন, আমার মনে হইতেছে উনি (মামুনুল হক) পুরা নিজে ফাঁইসা গেছে।’
জবাবে হেফাজত নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘এখন আমরা এত মর্মাহত, এত কষ্টে আছি। ভাবছি, উনি তো বিপদেই আছে, উনি কেমন কষ্টে আছে। এখন আমরা কিছু করতে পারতেছি না। আমি হ্যাং হয়ে গেছি। বুঝছেন না? আর আপনি কোনো সমস্যা নাই তো না?’
জবাবে ঝর্ণা বলেন, ‘এখন কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আপনাদের মুখ দিয়ে যা শুনতেছি এভাবে যদি বলে তাহলে তো আমি আমার মানে প্রবলেমে পড়ে যাবো।’
ঝর্ণা ও হুজুরদের বক্তব্যে যেন ‘অমিল’ না থাকে উল্লেখ করে ওই নারী আরও বলেন, ‘আমার কথা আর হুজুরের কথা এক থাকতে হবে। কিন্তু সে এখন একেকজনের কাছে একেক কথা বলতেছে। সেইগুলা ফাঁসও হয়ে যাইতেছে। তাহলে আমার কথা আর তার কথা কি এক থাকবে? উনি একসঙ্গে কেন অটল থাকতে পারল না? টিএনও সাহেব যখন বলল, যখন ওসি সাহেবকে বলল, আমি রেকর্ড করে রাখতে পারি নাই। তখন সাংবাদিক ছিল না। তখন উনি যখন এই কথাগুলো বলল, তখন উনি এই কথাগুলোর ওপর অটল থাকলেই তো হয়ে যেত। সত্যর জানেন সবসময় না জয় হয়, আর মিথ্যার সবসময় অপমৃত্যু হয়। উনি কেন মিথ্যার আশ্রয় নিলো?’
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হক বলেন, 'মামুনুল বলেন, ‘আমি নিজের বিবেকের কাছে, নিজের কাছে এবং আলিমুল গায়েব, সর্বজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে স্পষ্টভাবে নিষ্কলুষ। যে ধরনের অভিযোগ দিয়ে আমার চরিত্রকে হরণ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি নিরপরাধ এবং এই ধরনের কোনো চারিত্রিক কোনো কালিমা আমার উপর নেই। এই বিষয়ে আমি এতটাই নিজের ওপর কনফিডেন্ট।
তিনি বলেন, ‘সেই জায়গাটা থেকেই আমি মুবাহিলা করার মতো সৎ সাহস আমি দেখিয়েছি।’
‘মুবাহিলা’র ব্যাখ্যা করে হেফাজত নেতা বলেন, ‘সবাই কথাটা বুঝতে না পারলেও যাদের আল্লাহর কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে, তারা জানেন মুবাহিলা বিষয়টা কেমন।
‘ইসলামের আলোকে কোরআনের আলোকে কোনো একটি বিষয় যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে অমীমাংসিত হয়ে যায়, বিতর্কে আর যখন কোনো মীমাংসার সুযোগ না থাকে, কোরআন বর্ণিত সর্বশেষ সমাধানের পথটাই হলো মুবাহিলার পথ।’
তিনি বলেন, ‘সেই নারীর সঙ্গে দুই বছর পূর্বের বিবাহবন্ধন যদি শরিয়তসম্মতভাবে সম্পাদিত না হয়ে থাকে, জান্নাত আর ঝর্ণা আমার দ্বিতীয়া স্ত্রী- এই বিষয়ে যদি আমি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকি, তাহলে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আমার উপর গজব নাজিল হউক।
‘যদি কেউ আমার এই কথাকে অস্বীকার করতে চায়, যদি কেউ মুমিনের সন্তান ঈমানদার মুসলিম যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে আমার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ থাকল, আপনিও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন, আপনিও বলুন, আপনি যদি আমার প্রতি মিথ্যে অপবাদকারী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার উপর আল্লাহর গজব নাজিল হউক। দেখি, এই ধরনের সৎ সাহস কোনো মায়ের সন্তান রাখেন কি না।’
ফেসবুক লাইভে এসে হেফাজত নেতা এও বলেন যে, তার অসাবধানতা ছিল। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অসাবধানতার কারণে যে ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে, যে ত্রুটির কারণে, আমার অসাবধানতার কারণে এবং যথাযথভাবে আমি পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হযেছি, সেজন্য আমি নিজেই মর্মাহত।’
মামুনুল জানান, তিনি নিরাপদ ভেবে রিসোর্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, সেটি ধারণা করতে পারেননি।
হেফাজত নেতা বলেন, ‘রয়্যাল রিসোর্ট অত্যন্ত নিরাপদ জায়গা বলে আমার ধারণা ছিল। কিন্তু সেদিনের ঘটনায় আমি বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে পড়েছি। যে এই ধরনের একটি যেখানে বিদেশিরা অবস্থান করে থাকে, পর্যটকদের জন্য সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাকে যেভাবে ভঙ্গ করে, ধ্বংস করে দিয়ে যেভাবে আমার অনুমতি ছাড়া জোরপূর্বক আমার একান্ত কক্ষে প্রবেশ করা হয়েছে সেটি দেশবাসী তাদের প্রচারিত লাইভ ভিডিও ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও থেকে আপনার দেখেছেন।’
হেফাজত নেতা বলেন, ‘আমি অবশ্যই অকপটে স্বীকার করছি, এভাবে অসাবধানতা এবং নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে স্ত্রীকে সেখানে ঘুরতে যাওয়া বা সেখানে অবস্থান করাটা আমার জন্য সেই পরিস্থিতে সমীচীন ছিল না।
‘আসলে আমি এতটা আশঙ্কা করিনি যে আমাদের বাংলাদেশ এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সন্ত্রাসীরা এমন একটি নিরাপদ জায়গায়ও হামলা করতে পারে।’