লকডাউনে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গে আইডি কার্ড (পরিচয়পত্র) প্রদর্শন নিয়ে বাকবিতণ্ডা হওয়া ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশীদকে বরিশাল বিভাগে বদলি করা হয়েছে।
সেদিন এই ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালতে দায়িত্বরত ছিলেন। বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন যুগান্তরকে তার বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাকে (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) বদলি করা হয়েছে। তার বদলির বিষয়টি আগে থেকেই প্রক্রিয়াধীন ছিল।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পথে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন।জরিমানাও দিতে হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।এরমধ্যেই গত ১৮ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক ও চিকিৎসকের সঙ্গে আইডি কার্ড নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয় পুলিশ এবং কর্তব্যরত এক ম্যাজিস্ট্রেটের।সে সময় ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এ নিয়ে পুলিশ ও চিকিৎসকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেয়া হয়।এ ঘটনা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।হাইকোর্ট এই পাল্টাপাল্টি বিবৃতি কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেন।
পরে গেল বুধবার (২১ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে সঙ্গে পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) রাখা এবং ‘চাহিবামাত্র তা প্রদর্শন’ করার আহ্বান জানায়। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ চলাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিক্যাল ডিজিজের লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন বুলেটিনে বলেন, যে কোনো চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। পরিচয়পত্র, যে কোনো ধরনের আইডি কার্ড প্রদর্শনকারী স্বাস্থ্যকর্মীকে সহানুভূতির সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং দ্রুত ও বাধাহীন চলাচলের সুবিধা প্রদান করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নৈতিক দায়িত্ব।
সেদিন ম্যাজিস্ট্রেট মামুন যা বলেছিলেন: শেখ মো. মামুনুর রশীদ সেদিন বলেন, ‘আসলে ডাক্তার বললে আমরা আইডি কার্ডটা দেখছি, ছেড়েও দিচ্ছি। যাদের কার্ড নেই তারা অনেকেই ভিজিটিং কার্ড দেখাচ্ছেন, আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। ওনাকে ওসি সাহেব কার্ডটা দেখতে চেয়েছিল। এরপর ডাক্তার উত্তেজিত হয়ে যান। তারপর আমাকে ডেকে নেন।’
কিন্তু অ্যাপ্রোন পরা বা গাড়িতে সিল থাকার পরও কি আইডি কার্ড চেক করার কোনো কারণ ছিল?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে এখন তো অনেকেই এমন ভুয়া পরিচয় দিয়ে থাকেন। ভুয়া ডাক্তার আমরা দুই একজন পাচ্ছি। সবাই তো সব সময় আইডি কার্ড নিয়ে বের হয় না। কিন্তু ওনার কাছে আইডি কার্ড চাওয়া হলেই উনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন।’
পরিস্থিতি কীভাবে সামলেছেন, সেটিও জানান ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বলেন, ‘আসলে আমি ওই সময় শুধু ওনাদের দুইজনের কথা চিন্তা করিনি। আমি চিন্তা করেছি সারা দেশের। যদি কোনো একটা অঘটন ঘটে তবে অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেত। পুলিশ একটা ঝামেলা করবে আবার ডাক্তাররাও একটা ঝামেলা করবে। তাই আমি চেষ্টা করছি বিষয়টি সমঝোতা করে ফেলতে।
‘ওসিকে আমি বুঝিয়েছি। ওনার (ডাক্তারের) সাথে আরেকজন ছিলেন। পরে তার সাথে কথা বলে তাকেও বুঝিয়েছি। এরপর বিষয়টি এভাবেই সমাধান হয়েছে।’
সেই ঘটনায় পুলিশ-ডাক্তার দ্বন্দ্ব: ১৮ এপ্রিলের সেই ঘটনাটি এর আগের বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। ১৪ এপ্রিল লকডাউন শুরুর হওয়ার পর পরিচয়পত্র দেখেও পুলিশ স্কয়ার হাসপাতালের এক চিকিৎসককে জরিমানা করে। সেদিন এক চিকিৎসককে ‘কসাই’ সম্বোধন করার অভিযোগও আছে।
আবার দুই জন চিকিৎসকের গাড়িচালককে জরিমানা করা হয়েছে। তারা চিকিৎসকদেরকে কর্মস্থলে দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। একটি ঘটনায় চিকিৎসক নিজে পুলিশের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে তাকে বলা হয়েছে, বেশি কথা বললে জেল দেয়া হবে।
এর মধ্যে ডা. জেনির সঙ্গে ওই ঘটনাটি আগুনে ঘি ঢালে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে তার তুলনাকে মেনে নিতে পারেননি চিকিৎসকরা। নিউমার্কেট থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবিতে বিবৃতি আসে গণমাধ্যমে।
এ ঘটনার পর চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তাদের হয়রানি করা হলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে।
বিপরীতে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে এই ঘটনায় ডা. জেনিদে দায়ী করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আর্জিও জানানো হয়েছে।
ঘটনার প্রেক্ষিতে এক ব্রিফিংয়ে চিকিৎসকদের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার জন্য আহ্বান জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি সড়কে চিকিৎসকদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।