Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৯ শুক্রবার, মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

বাবুল আক্তারের ‘পরিকল্পনায়’ মিতু খুন: সামনে আসছে মুছার 'নিখোঁজ' রহস্য

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২১, ১১:৪৮ AM
আপডেট: ১২ মে ২০২১, ১১:৪৮ AM

bdmorning Image Preview


পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডে তাঁর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে ‘আটক’ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তিনি এই হত্যা মামলার বাদী।

গত সোমবার রাতে ঢাকা থেকে বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রামে আনা হয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, মামলার বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানালেও পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।

পিবিআইয়ের প্রধান উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘মামলার বাদীকে চট্টগ্রামে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’ আর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত বাদী চট্টগ্রামে আছেন।’

এদিকে, পিবিআই সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বুধবার তাকে আদালতে হাজির করে গ্রেফতারের আবেদন করা হবে। মিতু হত্যা মামলার বাদি তার স্বামী বাবুল আক্তার। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করার বিষয়টি আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে করে তিন দুর্বৃত্ত মিতুকে ঘিরে ধরে প্রথমে গুলি করে। এরপর কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। ওই সময় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তার আগে তিনি চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন বাবুল আক্তার। মামলাটি চট্টগ্রামের নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ৩ বছর ১১ মাস তদন্তে থাকার পর গত বছরের মে মাসে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হলেন পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বাবুল আক্তার মামলার বাদি। তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন বুধবার আদালতে পাঠানো হবে।

সেই কল রেকর্ড : ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত মুছার মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মিতু হত্যার প্রধান আলামত ও সাক্ষী। সালাম দিয়ে মুছা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান? ৩/৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি? ওপার থেকে মুছার কথা, না মানে’।’ বাবুল আক্তার ফোনটি কেটে দেন। এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছু দিন পর বাবুল আক্তার পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল দুই সন্তান আক্তার মাহমুদ মাহী ও তাবাসুম তাজনিন টাপুরকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীর ভূঁইয়া পাড়ার শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর আলাদা বাসা ভাড়া করে সন্তানদের নিয়ে চলে যান। বাবুল আক্তার পরে মগবাজারে একটি হাসপাতালের কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন।

বাবুল-মিতুর দাম্পত্য কলহ: পরকীয়া প্রেমের এসএমএস নিয়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় হত্যার সাত মাস আগে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মিতু আপত্তিকর কিছু এসএমএস দেখতে পান। সেখানে গায়েত্রী এম্মার্সিং নামের এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারে মিতু। এ নিয়ে বাবুল আক্তারের প্রত্যহ বাকবিতণ্ডা শুরু হয় দুজনের মধ্যে।

মিতুর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ সালের ডিসেম্বরের এক বাবুল আক্তার বিছানার উপর মোবাইল ফোন রেখে বাথরুমে যান। এসময় একটি এসএমএস আসে বাবুলের মোবাইলে। তখন মিতু এসএমএসটি চেক করে দেখতে পান একটি আপত্তিকর বার্তা। তখন মিতু মোবাইলটির সুইস বন্ধ করে বাসার স্টোর রুমে ফোনটি লুকিয়ে রাখে। এরপর বাবুল আক্তার ফোন খোঁজাখুঁজি করলে মিতু ফোনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরদিন বাবুল আক্তার বাসা থেকে বের হলে মিতু মোবাইলের সিম বের করে মোবাইলটি অন করেন। এরপর ওই মোবাইল থেকে একে একে ২৯টি এসএমএস (ক্ষুদে বার্তা) পড়েন। পরে এ ব্যাপারটি মিতু প্রমাণ হিসেবে ছেলের ছবি আঁকার আর্ট পেপারে লিখে রাখেন। এদিকে মোবাইল না পেয়ে বাবুল আক্তার ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হন যে তার মোবাইল ফোনটি বাসাতেই রয়েছে। এই মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মিতু ফোন দেয় তার মায়ের কাছে।

কি ছিল সেসব ম্যাসেজে: মিতুর মায়ের দাবি করা একটি আর্ট পেপারে লেখা ২৯টি মেসেজের সবগুলোই ইংরেজিতে লেখা। মেসেজগুলোতে গায়ত্রী ও বাবুলের মধ্যে গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি মেসেজে এমন লেখা হয়েছে, মাই পোয়েট মাই লাভ কাম টু মি’, লাভ ইউ মাই কিং উলড হ্যাভ কিসড ইউ প্যাশোনেটলি, ইফ ইউ ওয়্যার হেয়ার নাউ’, লাভ ইউ বেবি, গুড মর্নিং, কাম টু স্লিপ টু মি’।

গায়ত্রী এম্মারসিং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে প্রতিরোধ শাখার একজন কর্মকর্তা হিসাবে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তখন বাবুল আক্তার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে গায়ত্রী এম্মারসিং সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কর্মরত।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড : ২০১৬ সালের ২৪ জুন বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুন আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলে, কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুছার ‘পরিকল্পনাতেই’ এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানায়, নবী, কালু, মুছা ও তিনি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। হত্যার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সামনে ছিল মুসা, এরপর আনোয়ার ও একদম পেছনে ছিল সে। মোটরসাইকেলের পিছন থেকে সে প্রথমে মিতুকে গুলি করে। জিইসির মোড়ে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা নবী তার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পুরো সময়টা বাবুল আক্তারের ছেলেকে আটকে রেখেছিল মুসা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা চলে যায়। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই আসামি নূরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। মুছাসহ দুইজন আসামি গুম হয়ে গেছে। এই মামলায় বর্তমানে ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী। নবী, কালুসহ ৩ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

শুরু থেকে চট্টগ্রাম পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) মামলাটির তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেন।

Bootstrap Image Preview