হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল হলেও পাঁচটি জটিল সমস্যা চিহ্নিত করেছে মেডিকেল বোর্ড। তার লিভার, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা বেশ প্রকট বলে মত দিয়েছেন বোর্ডের সদস্যরা। এসব জটিল সমস্যার আগাম উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আরও উন্নততর ও বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো হাসপাতালে স্থানান্তরের জোর সুপারিশ করেছে মেডিকেল বোর্ড। প্রতিবেদনে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও এ ধরনের উন্নত চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সর্বশেষ গত সপ্তাহে প্রণীত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি সংশ্নিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে সমকাল পেয়েছে।
প্রতিবেদনে ক্রনিক লিভার সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রতিস্থাপনের আগাম পরিকল্পনা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি প্রস্রাব ধরে রাখতে পারছেন না এবং প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, হৃদযন্ত্রের স্পন্দন অনিয়মিত হওয়ায় অস্বাভাবিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তিনি। কিডনি এবং লিভার রোগের কারণে বাতজনিত জয়েন্টে তিনি বেশ সমস্যায় আক্রান্ত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার ক্যান্সার মার্কার উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে এবং তার পারিবারে ক্যান্সারের ইতিহাসও রয়েছে উল্লেখ করে এ সমস্যাটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনা উচিত বলে মনে করে মেডিকেল বোর্ড।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত হলেও পুরোনো কিছু রোগের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখনও ঝুঁকিমুক্ত নন। তার মেডিকেল বোর্ডের সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, খালেদা জিয়ার ফান্ডামেন্টাল কিছু সমস্যা রয়েছে, যেগুলো উদ্বেগজনক। তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা, কিডনির সমস্যা আছে। এ দুটি সমস্যা নিয়ে মেডিকেল বোর্ড উদ্বিগ্ন। বোর্ডের সদস্যরা মনে করছেন, বাংলাদেশে যে হাসপাতালগুলো আছে, অ্যাডভান্স সেন্টারগুলো আছে, সেগুলো যথেষ্ট নয় তার ট্রিটমেন্টের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বার বার বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট দরকার, তার অসুখগুলো নিয়ে অ্যাডভান্স সেন্টারে যাওয়া জরুরি। আমরা সেটা বারবার বলছি।
খালেদা জিয়ার এই বিষয়গুলো নিয়ে জামিনের জন্য আদালতে যাবেন কিনা- প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, আগেও বলেছি, এরকম প্রশ্নের উত্তর আমরা দিয়েছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আদালতে। একেবারে রাজনীতি থেকে শুরু করে আইনগতভাবে আদালতে ক্ষতিটা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছেন। এখনও সরকারের দিক থেকে কোনো 'গ্রিন সিগন্যাল' তারা পাননি। তারা আশা করছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করবে সরকার।
প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে: মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্ডিয়াক মার্কার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। ইকো পরীক্ষায় তার হার্টের প্রসারণ ক্ষমতার অক্ষমতা বা ডায়াস্টোলিক ডিসফাংশন ধরা পড়েছে, যদিও তার সংকোচন ক্ষমতা বা সিস্টোলিক ফাংশন অটুট রয়েছে। অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের আশঙ্কা রয়েছে ডায়াস্টোলিক দিক থেকে। তার বুকের সিটি স্ক্যানে তুলনামূলক পর্যবেক্ষণে দু'দিকের ফুসফুসে পানির উপস্থিতি ধরা পড়েছে। পেটের সিটি স্ক্যানে পেটে পানি আসাসহ নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগ ধরা পড়েছে।
বোর্ডের সদস্যরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার হার্ট, বুক ও পেটে পানি আসার মূল কারণ লিভারের রোগজনিত এলবুমিনের ঘাটতি। ২৮ ও ২৯ মে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও হঠাৎ ৩ জুন রাত সাড়ে ৩টার দিকে তার আবার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং তিনি শুয়ে থাকতে পারছিলেন না। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৩-৯৬ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করছিল।
এর আগে খালেদা জিয়ার রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিল (১৩০/৮০ মিমি মার্কারি), শ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক অর্থাৎ ২২/মিনিট এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশনও স্বাভাবিক অর্থাৎ ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ ছিল। ওই দিনই সকাল সাড়ে ১১টায় তার ফুসফুসের বাম দিকে পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও কমে ৯৩-৯৬ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করছিল। ওই সময় তার শরীরে জ্বর (১০০ ডিগ্রি) ছিল, ব্লাডপ্রেশার ছিল ১৩০/৮০ মিমি মার্কারি আর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার ২৪/মি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ অবস্থায় বোর্ডের সদস্যরা খালেদা জিয়ার ফুসফুসের পানি শ্বাস-প্রশ্বাসের সুবিধাসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বের করার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেন। তাকে শিরাপথে অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনাম এবং মক্সিফ্লোক্সাসিন এবং মুখে লিনেজোলাইড দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খালেদা জিয়াকে এ ধরনের বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সিসিইউতে আলট্রাসনোগ্রামের সাহায্যে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিশেষ ক্যাথেটারের মাধ্যমে তার বাম দিকের ফুসফুস থেকে ৫৫০ মিলি রক্তযুক্ত পানি পাইপ দিয়ে বের করা হয়। হাতের ওপরের দিকের শিরাপথে চিকিৎসার সুবিধার্থে ক্যাথেটার লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় খালেদা জিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল এবং এ জন্য তাকে সারাক্ষণ এক-দুই লিটার অক্সিজেন দিয়ে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। তার বুকের টিউব আরও ১৮ দিন সেখানে রেখে দেওয়া হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত রক্তযুক্ত তরল পদার্থ বর্ণহীন হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেদা জিয়া ক্যাথেটারবাহিত মারাত্মক সেপসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন- যার সফল চিকিৎসা অ্যান্টিবায়োটিক সহযোগে ইতোমধ্যে করা হয়েছে। তার মলের সঙ্গে অনবরত একটু একটু রক্ত যাচ্ছে, যার জন্য তাকে ৪ ইউনিট প্যাক্ট আরবিসি দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হার্টের অবস্থা স্থিতিশীল হলেও মাঝে মাঝে কিছু অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে।
মেডিকেল বোর্ড সদস্যরা যা বলছেন :মেডিকেল বোর্ডের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদ্যমান জটিল সমস্যাগুলোর সুচিকিৎসার জন্য সর্বাধুনিক সমন্বিত চিকিৎসা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। এমনকি পরবর্তী ফলোআপ চিকিৎসার জন্য আধুনিক বহুমুখী স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম হাসপাতাল প্রয়োজন। এ ধরনের হাসপাতাল বাংলাদেশে নেই।
বোর্ডের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গত পাঁচ-ছয় বছর যে মেডিকেল চেকআপ প্রয়োজন ছিল- তা সম্ভব হয়নি। লিভার, কিডনি আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল, তা করোনার কারণে আরও খারাপ হয়েছে। লিভার ও কিডনি প্রায় অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক কার্যক্রম যথাযথভাবে করছে না। করোনা জটিলতার উপসর্গ হিসেবে খাদ্যনালিসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। মলের সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে। লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আয়রন, প্রোটিন ও হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এ পর্যন্ত তাকে চার ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আয়রন ও প্রোটিন দেওয়া হয়।
বোর্ডের অপর এক সদস্য জানান, হৃদযন্ত্র মাঝে মাঝে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সমস্যার কারণে হাড়ের ভিন্ন জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া দৈনন্দিন কাজ করতে পারেন না। এটা ক্রনিক লিভার ডিজিজ ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজের কারণে। এ রোগের চিকিৎসা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
৭৬ বছর বয়স্ক খালেদা জিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৭ এপ্রিল ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে শ্বাসকষ্ট বাড়লে গত ৩ মে তাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। দুটি নল স্থাপন করে তার ফুসফুস থেকে পানি অপসারণ করা হয়। খালেদা জিয়া করোনামুক্ত হন ৯ মে। সিসিইউতে থাকা অবস্থায় গত ২৮ মে খালেদা জিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। ৩০ মে তার জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসে। ৩ জুন তাকে সিসিইউ থেকে কেবিনে আনা হয়। খালেদা জিয়ার কভিড-পরবর্তী জটিলতার কারণে এরপর থেকে হাসপাতালে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে। গত ১৪ এপ্রিল গুলশানের বাসা 'ফিরোজা'য় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিএনপিপ্রধান।
সূত্রঃ সমকাল