ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের প্রথম স্ত্রী আবিদা নুরের মোবাইল ফোনে কল আসা মেহেদি হাসান পরিচয়ধারী ব্যক্তির এখন পর্যন্ত ‘অস্তিত্ব’ পায়নি পুলিশ। আদনানের আগের একটি মোবাইল সিম ব্যবহার করে আবিদা নুরের কাছে কল দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন কথিত ওই মেহেদি হাসান। এমন অভিযোগ আদনানের স্বজনদের। এ দিকে ত্ব-হা আদনানের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটিতে মেসেজ পাঠানো হলে এর উত্তর দেয়া না হলেও ‘সিন’ করা হচ্ছে।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, ইন্টারনেটভিত্তিক নাম্বার (০৯৬৯৬৯৭৭০৬৪৭) থেকে নিখোঁজ ইসলামী বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের স্ত্রীর কাছে ফোন আসা সেই মেহেদী হাসানকে এখনো ট্রেসিং করা সম্ভব হয়নি। তার কোনো অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে মেসেজ সিন হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ দিকে আদনানের বোন রিতিকা রুবাইয়াত ইসলাম অনন্যা বলেন, ’নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন শনিবার সন্ধ্যায় ইন্টারনেটভিত্তিক আলাপ নাম্বার ০৯৬৯৬৯৭৭০৬৪৭ থেকে ভাবি আবিদা নুরের (আদনানেন প্রথম স্ত্রী) মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ওই নাম্বারটি আমার ভাইয়া ব্যবহার করতেন। কিন্তু অনেক দিন ধরে সেটি বন্ধ ছিল। ফোনের ওপার থেকে নিজেকে মেহেদি হাসান পরিচয় দেন এক ব্যক্তি। এসময় ওই ব্যক্তি ফোনে বলেন, আদনানসহ অন্যরা তাদের কাছে আছে। টাকা পয়সা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন তিনি ইমু নাম্বার খুলতে বলেন। এরপর ফোন কেটে দেন। পরে আমরা বারবার ট্রাই করলেও ওই ফোনে কল ঢোকেনি। একপর্যায় ভাবির নাম্বারে আমি ইমু খুললে তিনি ইমুতে মেসেজিং করেন। সেখানেও তিনি একই ধরনের কথা বলেন ও টাকা চাওয়ার বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য বলেন।’
অনন্যা আরো জানান, ‘রোববার সন্ধ্যায় ঠিক একই সময়ে বেশ কয়েকবার আমার ভাইয়ের আরেকটি মোবাইল নম্বর থেকে আবারো ভাবির নম্বরে কল আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা ফোন ধরতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার ওই নাম্বারে ভাবি কল ব্যাক করলে তখন বন্ধ পাওয়া যায়। বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে রাত ১১টার দিকে ইন্টারনেটভিত্তিক আলাপ নাম্বারে আমি ফোন দেই ভাবির ফোন থেকে। তখন মেহেদি হাসান নামের ওই ব্যক্তি ফোনটি ধরে বলেন, আপনাদের টাকা জোগাড় হয়েছে? টাকা দিলে আদনানদের ছেড়ে দেব।’
অনন্যা বলেন, 'এসময় আমি ফোনটি আমার মায়ের কাছে দেই। আমার মা তখন ফোনে তাকে বলেন, আমি আমার ছেলের কণ্ট চিনি। আপনি আমার ছেলেকে দেন তার সাথে কথা বলি। তারপর টাকা জোগাড় করবো। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে সেটি না করে রাগ করে ফোন কেটে দেয়া হয়। এরপর ওই নম্বর দু’টিতে আমরা বারবার ফোন দিলেও তা বন্ধ পাচ্ছি।’
আদনানের বোন অনন্যা আরো বলেন, ‘ভাইয়ের টেলিটক নাম্বারটি দিয়ে তার হোয়াটসঅ্যাপ খোলা। হোয়াটসঅ্যাপে আমি বিভিন্ন ধরনের মেসেজ পাঠাচ্ছি। কিন্তু কোনো রিপ্লাই পাচ্ছি না। তবে আমার মেসেজগুলো সিন করার হচ্ছে।’
অনন্যার দাবি, ‘সবকিচু আমরা পুলিশকে জানিয়েছি। পুলিশের কাছে তো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আছে। যেখানে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ সিন করা হচ্ছে। তাহলে হোয়াটসঅ্যাপের সূত্র ধরে কেন আমার ভাইসহ অন্যদের উদ্ধার করা হচ্ছে না?’
শুক্রবার সকালে আদনানের মা আজেদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আজ আট দিন হয়ে গেল। আদনানের কোনো খোঁজ করতে পারল না পুলিশ। ওর সাথে আরো তিনজন নিখোঁজ। আমাকে আর কত রাত জেগে ও কেঁদে কাটাতে হবে।’
যেভাবে নিখোঁজ হন আদনান: ১০ জুন দিবাগত রাত ২টা ৩৭ মিনিটে গাবতলী ও মিরপুরের মাঝামাঝি স্থান থেকে নিখোঁজ হন ইসলামিক স্কলার ও বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান। একইসাথে তার সফরসঙ্গী মোহাম্মদ আবদুল মুহিত আনসারী, ফিরোজ আলম ও গাড়িচালক আরিফ উদ্দিন মো: ফয়েজও নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবেকুন নাহার ঢাকার দারুসসালাম থানায় গেলে পুলিশ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা কিছুই গ্রহণ করেনি। পরে রংপুর কোতোয়ালি থানায় আদনানের মা আজেদা বেগম ও নিখোঁজ আরেকজনের ছোট ভাই ফয়সাল পৃথক দু’টি জিডি করেন। ১৪ জুন রংপুরের জিডির সূত্র ধরে রাজধানীর পল্লবী থানায় একটি অভিযোগ গ্রহণ করা হয় সাবেকুন নাহারের। এরই মধ্যে সাবেকুন নাহার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, র্যাব ও পুলিশের সদর দফতরে আদনানসহ নিখোঁজদের সন্ধান চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। এ ছাড়া ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনও করেছেন তিনি। কিন্তু এ পর্যন্ত তার সন্ধান করতে পারেনি পুলিশ।
কে এই আদনান? আবু ত্ব-হা আদনান রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি, রংপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০০৯ সালে এইচএসসি ও কারমাইকেল কলেজ থেকে দর্শন বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। আরবি শেখেন বাড়ির পাশের আল জামিয়া আল সালাফিয়া মাদরাসায়। ২০১৮ সালে চ্যানেল নাইনের আলোকিত জ্ঞানী অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সারাদেশের মধ্যে রানার্সআপ হয়েছিলেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিনি ওমরা পালন করে আসেন। এরপর আদনান ইউটিউবে একটি চ্যানেল খুলে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। ওই ইউটিউব চ্যানেলে তিনি কুরআন শিক্ষার আসর করেছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন মসজিদে তিনি খুতবা ও ইসলামী অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখতেন ও তা ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করতেন। এভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক তার বিপুল পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার্স তৈরি হয়েছিল।
রংপুর মহানগরীর পায়রা চত্বর সেন্ট্রাল রোডের হাজী লেনের মামার বাড়িতে মা, বোন ও প্রথম স্ত্রীসহ থাকতেন তিনি। আড়াই বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নিজে আয় করেই সংসার চালাতেন আদনান। তার প্রথম স্ত্রী আবিদা নুরের তিন বছর বয়সি ছেলে ও দেড় মাস বয়সী একটি মেয়ে সন্তান আছে। এর মধ্যে তিন মাস আগে তিনি ঢাকার মিরপুরে সাবেকুন নাহার নামে এক নারীকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সাবেকুন নাহার মিরপুরে আদনানের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার পরিচালক।