করোনা মহামারিতে গত বছর বিশ্বে ক্ষুধা ও অপুষ্টি সমস্যা অস্বাভাবিক অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ ।
এর আগে, পাঁচ বছর অপরিবর্তিত থাকার পর গত বছর অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ কোটির বেশি। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। এশিয়াতেই এই সংখ্যা ৪১ কোটির বেশি। মহামারি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে ক্ষুধামুক্ত করতে এক যুগেরও বেশি সময় প্রয়োজন। মহামারি শুরুর পর খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্মিলিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও ), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আজ যৌথভাবে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিষয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক পর্যালোচনা শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা উঠে এসেছে, যে চ্যালেঞ্জগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের অপুষ্টির অবসান ঘটানো সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ২) অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘের এই চার সংস্থার আঞ্চলিক প্রধানদের যৌথ এক বিবৃতিতে বলা হয়,‘অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি ভীষণভাবে কমে গেছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে,গত দুই বছরে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে,যা ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্পর্কিত এসজিডির ২ নম্বর লক্ষ্য অর্জনকে ক্রমান্বয়ে কঠিন করে তুলছে।’
মানুষ ও অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি
বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অংশের বসবাস এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মারাত্মক অপুষ্টি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে এবং প্রায় সব বয়সী মানুষের ওপরেই অপুষ্টির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে বিশেষ করে শিশুদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে এবং তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অঞ্চলে ৭ কোটি ৯০ লাখ শিশু বা পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি চার শিশুর একজন খর্বাকৃতির সমস্যায় ভুগছে এবং ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুর জীবন অকেজো হয়ে যাচ্ছে, যাদের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ভয়াবহভাবে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও গত দশকে শিশুর খর্বাকৃতির সমস্যা নিরসনে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে শিশুর জীবন অকেজো হয়ে পড়া ঠেকাতে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে।
এই অঞ্চলে জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তা বলেন, ‘দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই যে, কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও এই অঞ্চলের একটি অগ্রহণযোগ্য বড় সংখ্যক শিশু অব্যাহতভাবে কয়েক ধরনের অপুষ্টির বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এটা একটা ব্যাপক মানব ক্ষতি। কেননা অপুষ্টি এবং এর ফলে শিশুর দুর্বল মানসিক বিকাশের ভবিষ্যতে এই শিশুদের জীবনভর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়।’ এছাড়া মানব জীবনের সম্ভবনা কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় এটা একটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিতেও ভূমিকা রাখে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যয়-মুনাফার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে,পুষ্টিজনিত কিছু হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রতি এক ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ১৬ ডলার পর্যন্ত ফেরত পাওয়া যেতে পারে।
অপুষ্টির চালিকা শক্তি ও নির্ধারকসমূহ
এই অঞ্চলে জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগের ঘটনা বেড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় তা খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং পরবর্তী সময়ে এই বিরূপ প্রভাব পুরো খাদ্য শৃঙ্খলে নেমে এসে মানুষের জীবিকাকে প্রভাবিত করছে এবং অর্থনীতি ও কৃষি খাতের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে এই ক্ষতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো সম্পদ ও গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষতিসাধনের এবং রোগব্যাধির ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাবের মাধ্যমে কৃষিখাতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এফএও-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫-২০১৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এশিয়ায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। দেশগুলোর এমন কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন যা জলবায়ু সম্পর্কিত ঘটনার সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য ও পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা (ডব্লিউএএসএইচ বা ওয়াশ) সেবা প্রাপ্তির সীমিত সুযোগ বা সুযোগহীনতা শিশুদের মাঝে অপুষ্টির আরেকটি প্রধান চালিকা শক্তি। অপুষ্টি কমাতে উল্লেখযোগ্যমাত্রায় ভূমিকা রাখার জন্য এই অঞ্চলজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও ওয়াশ কর্মসূচি উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং এর আওতা অবশ্যই বাড়াতে হবে।
বিদ্যমান ক্ষুধা ও ক্রমবর্ধমান স্থূলতা: অন্য সবক্ষেত্রে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলে অগ্রহণযোগ্য উন্নয়ন
প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্ক উভয় শ্রেণির মাঝেই স্থূলতা বৃদ্ধির একটি বিপরীতধর্মী চিত্রও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি হারে স্থূল শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এরই মধ্যে দ্রুত গতিতে অতিরিক্ত ওজনের শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে যা ভবিষ্যতে তাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে হুমকির মুখে ফেলছে। আনুমানিক পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ কোটি ৪৫ লাখ শিশুর ওজন বেশি এবং কার্যত এই অঞ্চলের সব শিশুই ক্রমবর্ধমান হারে সস্তা, অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করছে, যেসব খাবার অতিরিক্ত মাত্রায় লবণ, চিনি ও চর্বিযুক্ত হলেও প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপুষ্টির এই দ্বিমুখী বোঝার কারণে একই কমিউনিটিতে ও পরিবারে একইসঙ্গে অপুষ্টিতে আক্রান্ত ও অতিরিক্ত ওজনের শিশু দেখা যাচ্ছে, এবং এটা এমনকি একই শিশুর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।’
যেহেতু গ্রামীণ এলাকা থেকে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর শহরে অভিবাসন অব্যাহতভাবে বাড়ছে, তাই অনেক দেশেই শহুরে অপুষ্টি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। নগরায়নের বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়ার জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশেরও বেশি নগর অথবা শহরের বাসিন্দায় পরিণত হবে। যদিও নগরায়ন অর্থনীতির জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে, তবে এই বৃদ্ধির হার সবসময় সমতাভিত্তিক হয় না এবং এটা অনেক সময় উচ্চমাত্রায় এবং দীর্ঘমেয়াদে শিশুর অপুষ্টির কারণ হতে পারে এবং একই কারণে শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের স্থূলতার হারও দ্রুত বাড়তে পারে।
জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর প্রধানদের মতে, ‘এই অঞ্চলের অব্যাহত উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির উন্নয়নে বৈপরীত্য রয়েছে।’ তারা আরও উল্লেখ করেন, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই এখন এসডিজির ২ নম্বর লক্ষ্য এংব বিশ্ব স্বাস্থ্য সভার পুষ্টি বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দেশগুলোতে শান্তি গড়ে তুলতে এবং তা টেকসই করতে অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টায় তাদের হাতে হাত রেখে সামিল হতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করে মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ায়- এমন কার্যক্রমগুলো জরুরি ভিত্তিতে জোরদার করা প্রয়োজন।
এফএও, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও: ‘জরুরি প্রয়োজনবোধকে অবজ্ঞা করা যাবে না’
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, মা ও শিশুস্বাস্থ্যে উন্নয়ন ঘটানো ও তাদের কল্যাণ সাধনে সহায়তা করতে দায়বদ্ধ জাতিসংঘের চারটি সংস্থা এবারই প্রথমবারের মতো যৌথভাবে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের যৌথ প্রচেষ্টা বর্তমান অবস্থার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে এবং এই অঞ্চলজুড়ে ক্ষুধার অবসান এবং উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সরকারগুলোর আগের প্রতিশ্রুতি পূরণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জোরদার করেছে।
প্রতিবেদনের সারাংশ তুলে ধরে জাতিসংঘের এই চারটি সংস্থা বলছে, ‘ক্রমেই যা পরিষ্কার হচ্ছে তা হলো’ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না যদি বিশ্বের সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এক্ষেত্রে নেতৃত্ব না দেয়। এটি একটি কঠিন বাস্তবতা, তবে এই বাস্তবতাকে বদলে দিতে সম্মিলিতভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
আশাবাদের একটি সতর্ক নোট দিয়ে এই প্রতিবেদনে সমাপ্তি টানা হয়েছে,যেখানে বলা হয়েছে, ‘সম্মিলিতভাবে আমরা আশাবাদী যে, এই প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তা আরও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনায় ভূমিকা রাখবে। কোনো ধরনের সন্দেহ না রেখে একটি স্বাস্থ্যকর ও ক্ষুধামুক্ত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রগতি জোরদার করতে অংশীজনদের অবশ্যই তাদের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে এবং তাদের সেই প্রচেষ্টা এখনই দরকার। জরুরি প্রয়োজনবোধকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না।