‘নো পিল, নিউ ফিল চাই। বরফ আছে? হ্যাভ স্টাফ?’—কথিত হাউস পার্টির নামে ভাড়া ফ্ল্যাটে নেশার জগতে মিলিত হওয়ার আগে একজন আরেকজনকে মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে এমন মেসেজ দেন। অপর প্রান্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের বিপথগামী এক যুবক জবাব দেন—‘ইয়েস, হ্যাভ’।
ইন্টারনেটে এভাবেই চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে স্টাফ ও বরফ বলে ডাকা হচ্ছে নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইয়াবাকে বলছেন পিল। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় হাউস পার্টির আড়ালে উচ্চবিত্ত পরিবারের বিপথগামী শতাধিক তরুণ-তরুণীকে ঘিরে চলছে এই কারবার। ‘স্টাফ’ কারবারে এই গ্যাং গ্রুপে অন্তত ২০ জন আছেন, যাঁরা আইস সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন।
সম্প্রতি কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, ব্যবসায়ী মিশু হাসান, তাঁর সহযোগী জিসান গ্রেপ্তারের পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ২১ আগস্ট নজরদারির মাধ্যমে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে।
ডিএনসি ও র্যাবের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, টেকনাফ থেকে আইস এনে তা গোপন চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে উচ্চবিত্তদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। একই চক্র ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রির পাশাপাশি এস্কট বা অন্যান্য অনৈতিক কারবারও চালাচ্ছে। তারা নতুন মাদকের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছে।
মাদক আইস কারবারচক্রের অন্যতম তিন কুশীলব হলেন থাইল্যান্ড থেকে আসা জবির খান, হোটেলকেন্দ্রিক শাকিল ও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ইডেন। কিছু ফ্ল্যাটে কথিত পার্টির নামে তাঁরা অনৈতিক কার্যকলাপের পাশাপাশি প্রতারণাও করছেন। তাঁদের চক্রের বেশ কয়েকজন তরুণীর নামও পাওয়া গেছে। সম্প্রতি অভিযান জোরদার হওয়ায় তাঁরা গাঢাকা দিয়ে চলছেন। তবে আইসের কারবারিদের ধরতে নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন গোয়েন্দারা।
ডিএনসির অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া রোহিত হোসেন নামে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান একটি বড় সিন্ডিকেটের হোতা। মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান নামে গ্রেপ্তারকৃত আরেকজন বনানীর নিয়মিত আইস বিক্রেতা। বনশ্রী থেকে ডিএনসির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া হাসিবুল ইসলাম এসব গ্যাং গ্রুপে আইস সরবরাহ করতেন। তিনি একজন ডিলারের কাছ থেকে এই আইস সংগ্রহ করতেন।
ডিএনসির অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া অন্যরা হলেন রুবায়াত, মাসুম হান্নান, আমান উল্লাহ, মুসা উইল বাবর, সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান, লায়লা আফরোজ প্রিয়া ও তানজীম আলী শাহ। তাঁদের কাছ থেকে পাঁচ শ গ্রাম আইস ও পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। গত ২৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত পাঁচজনের এক দিন করে এবং ৩১ আগস্ট দুইজনের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের আইস কারবার নেটওয়ার্কের ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, মেহেরপুরের গাংনীর হাসিবের কাছে ২৫০ গ্রাম আইসের পাশাপাশি ইয়াবাও পাওয়া যায়। টেকনাফ থেকে মাদক আনা এক ডিলারের মাধ্যমে তিনি এগুলো সংগ্রহ করে অভিজাত এলাকার কারবারিদের দেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রোহিত ও ইভান বড় চক্রের সদস্য। তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন শতাধিক আইসসেবী ও কারবারি। এই চক্রের হোতা জবির খান।
হাউস পার্টির নামে অবৈধ কাজে জড়িত হিসেবে নাম আসা জবির এর আগে থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি দেশে নতুন মাদকের পরিচিতি তৈরিতে তৎপর। গুলশান-বনানী এলাকায় এস্কট সার্ভিসের নামে ইয়াবা ও আইসের কারবার করেন তিনি। হোটেলকেন্দ্রিক মডেল সরবরাহের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িত শাকিলও আইসের বড় ক্রেতা। তিনি মাদকাসক্ত অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে আইস খুচরা বিক্রি করেন। ইডেন নামে উচ্চবিত্ত পরিবারের আরেক যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের ‘স্টাফ’ ও ‘পিল’ সরবরাহ করেন।
ভিন্ন আরেকটি সিন্ডিকেটে ২০ জন রয়েছেন, যাঁরা আইস সেবনের পাশাপাশি বিক্রি করছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জান্নাতুল, বিশাল, সানি, সামিয়া আজাদ, নিশা, জুবায়ের, মেহনাজ, মির্জা, লগ্ন, বিকি, আসিফ, রাজ, হাসান, ইজাজুল, জমিল, নাতাশা, তাহমিদ ও আকিকুল। এঁদের কয়েকজনের অ্যাপে যোগাযোগের তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি নজরদারির মাধ্যমে নামগুলো যাচাই করা হচ্ছে।
ডিএনসি ও র্যাব সূত্র জানায়, গুলশান-বনানীতে পিয়াসা ও মৌ গ্রেপ্তারের পর তাঁদের অন্যতম সহযোগী মিশু হাসান ও জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে সাড়ে ১৩ হাজার পিস ইয়াবা ও সিসার উপাদান জব্দ করা হলেও আইস পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা অভিজাত এলাকা ঘিরে সহযোগী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক কারবারের কিছু তথ্য দেন। এর সূত্র ধরে নজরদারির মাধ্যমে হাউস পার্টির নামে আইস কারবারিচক্রের সন্ধান পান র্যাবের গোয়েন্দারা। প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ধারাবাহিক নজরদারিতে রোহিত, ইভান, জবির, হাসিবসহ কয়েকজনের নাগাল পায় ডিএনসি। এভাবে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও তিন বড় কারবারিসহ ‘স্টাফ গ্যাংয়ের’ অনেকেই এখনো অধরা। বনানীর একটি ফ্ল্যাট শনাক্ত করেছে ডিএনসি, যেখানে হাউস পার্টির নামে আইস সেবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে আসছিল। এমন ফ্ল্যাটগুলো শনাক্ত করে অভিযান চালাতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় সূত্র।
ডিএনসির সহকারী পরিচালক (ঢাকা-উত্তর) মেহেদী হাসান বলেন, ‘আইসের কারবারের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযানের সূত্রে আমাদের তদন্ত চলছে। কয়েকজনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরো দুজনকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেওয়া হবে।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ