আফগানিস্তানে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণা করেছে তালেবান। মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী করে আফগানিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণা করেছে তালেবান। পাশাপাশি তার ডেপুটি করা হয়েছে সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল গনি বারাদারকে।
মঙ্গলবার কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের প্রধান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানান, হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজউদ্দিন হাক্কানিকে ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে। আর তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা মো. ইয়াকুবকে করা হয়েছে প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবান ও আল কায়েদার সঙ্গে যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দিন হাক্কানির মাথার দাম পাঁচ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার উপ-প্রধান হিসাবে কাজ করবেন তালেবান গোষ্ঠীর সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার।
মোল্লা হাসান আখুন্দ স্বল্প পরিচিত তালেবান নেতা। তবে এবার তিনি আফগান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছেন। দেশটিতে পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের পতনের পর তাকে জনসমক্ষে দেখা যায়।
আল জাজিরার খবরে বলা হয়, আফগানিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী হবেন হেদায়েতুল্লাহ বদরী।
১৫ আগস্ট তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর থেকে তাদের সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখন তালেবান নেতারা বলেছিলেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের চিন্তা করছেন।
আর ২০১৬ সাল থেকে তালেবান গোষ্ঠীর অন্যতম উপনেতা মোল্লা ইয়াকুব তত্ত্বাবধায়ক প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
রাজধানী কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ নতুন সরকারের মন্ত্রীদের নাম জানিয়েছেন।
হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে এবং নেটওয়ার্কটির প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে। এই হাক্কানি নেটওয়ার্ক যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের কালো তালিকাভুক্ত।
সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের ‘মুজাহিদ’ নেতা জালালুদ্দিন হাক্কানির ছেলে হলেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি। গত কয়েক বছরে কাবুলে যে কয়টি বড় ধরনের আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছে, তা হাক্কানি নেটওয়ার্কেরই চালানো বলে মনে করা হয়।
আফগান কর্মকর্তাদের হত্যা, বিদেশি সৈন্যদের অপহরণের অভিযোগও রয়েছে এই দলটির বিরুদ্ধে। হাক্কানির মাথার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরষ্কারও ঘোষণা করেছে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, নতুন সরকারে নিয়োগ পাওয়া সবাই ভারপ্রাপ্ত হিসাবে কাজ করবেন।
মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে যে তালেবান আড়াই দশক আগে আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিয়েছিল; বিদেশি সেনাদের আক্রমণে পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতা হারাতে হলেও নতুন নেতৃত্বের অধীনে দুই দশক পর আবার দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা সেই প্রয়াত মোল্লা ওমরের সহযোগী মোল্লা হাসান আখুন্দকেই এবার সরকারের প্রধান করা হয়েছে। তালেবান নেতা হিসাবে তিনি তেমন সুপরিচিত না হলেও জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম আছে।
মোল্লা হাসান আখুন্দ বর্তমানে তালেবানের প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী পরিষদ ‘রেহবারি শুরা’ বা নীতি-নির্ধারণী পরিষদের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ শুরুর আগেও হাসান তালেবান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
সামরিক নেতা হিসাবে নয় বরং ধর্মীয় নেতা হিসাবেই মোল্লা হাসান বেশি পরিচিত এবং তিনি তালেবানের আধ্যাত্মিক নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুন্দাজার অতি ঘনিষ্ঠজনজন বলেও শোনা যায়।
তালেবান গোষ্ঠীর উৎসভূমি হিসাবে পরিচিত কান্দাহার থেকে মোল্লা হাসানের আগমন। তালেবান সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি।
নতুন তালেবান সরকারে মোল্লা হাসানের উপপ্রধান হিসাবে যিনি দায়িত্ব পালন করবেন, সেই মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার হচ্ছেন, দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের চেয়ারম্যান।
বারাদারও কান্দাহার রাজ্যের বাসিন্দা । তালেবান বাহিনী প্রতিষ্ঠায় তারও রয়েছে অবদান। অন্য অনেক আফগানদের মতো গত শতকের ৭০ এর দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বারাদারের লড়াইয়ের হাতেখড়ি। জনশ্রুতি আছে, সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি মোল্লা ওমরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন।
২০১০ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন বারাদার। কিন্তু ২০১৮ সালে কাতারে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা গতিশীল করতে ওয়াশিংটনের চাওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পরে তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন বারাদার। চুক্তিপত্রে তালেবানের পক্ষে সইটিও তিনি করেন।
ওদিকে, তালেবান সরকারের নতুন প্রতিরক্ষান্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে। মোল্লা হেবাতুল্লাহর ছাত্র ছিলেন তিনি। হেবাতুল্লাহ তালেবানের শক্তিশালী সামরিক কমিশনের প্রধান হিসাবে ইয়াকুবকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
যুদ্ধের কৌশল ঠিক করা, অভিযান পরিচালনা করা তার কাজের অংশ। বাহিনীতে শ্রদ্ধার পাত্র মোল্লা ইয়াকুব, তা অনেকটা তার প্রয়াত বাবার কারণে। যে কারণে দলে বিভেদ কিংবা কোন্দলের সময় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান তিনি।