২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে গলা কেটে হত্যা করেছিলেন ছাত্রদল ক্যাডার জাহিদ সরকার। সেই জাহিদই সামনে নৌকা প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চান। এ জন্য দরকার সব হত্যা মামলা থেকে বেকসুর মুক্তি! তাই নিহত সেই আওয়ামী লীগকর্মীর স্ত্রীকে চাপ দিচ্ছেন হত্যা মামলা তুলে নিতে এবং তাঁকে বিয়ে করতে। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার মামলা। এই অভিযোগ থেকেও খালাস পেতে জাহিদ নিহতের পরিবারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, ছাত্রদলের সিরিয়াল কিলার জাহিদ সরকার নরসিংদী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কবীর কামালের ক্যাডার ছিলেন। কুন্দারপাড়া এলাকার একসময়ের কুখ্যাত ডাকাত সর্দার জয়নালের ছোট ভাই জাহিদ। ১৯৯১ সালে স্থানীয় জনতা ব্যাংকে ডাকাতি করে ১০ লাখ টাকা লুট করেন জাহিদ। সেই ডাকাতি মামলায় তাঁর ১৭ বছরের কারাদণ্ডও হয়। তবে কয়েক বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি মুক্তি পান। এরপর
জামিনে থাকা অবস্থায়ই জাহিদ ২০০১ সালে কুন্দারপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মো. ফিরোজ মিয়া হত্যা মামলার মূল আসামি হন। পরের বছরই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে চাঁদপাশা এলাকার মো. ইউসুফ খন্দকারকে গুলি করে হত্যার।
মিলন মিয়ার স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী কী অপরাধ করেছিল? আওয়ামী লীগকে ভালোবাসত। এ জন্য সেই নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট হয়ে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিল; কিন্তু ভোটকেন্দ্রেই আমার স্বামীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও আমি স্বামীর হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, কিন্তু বিচার পাচ্ছি না।’
শারমিন আক্তার আরো বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়ে আমি পাগলের মতো ছিলাম। ঘটনার তিন দিন পর এমপি সাহেবের লোকজন এসে মামলা করতে আমার থেকে সই নিয়ে যায়। কাকে আসামি করা হচ্ছিল এটাও জানতাম না। পরে দেখি যাঁর এজেন্ট হয়ে আমার স্বামী খুন হয়েছে, তাঁরই লোক আমার স্বামীর আসল খুনি জাহিদ সরকার। সে আমাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। তাকে বিয়ে করে মামলা তুলে না নিলে আমাকে ও আমার তিন সন্তানকে মেরে ফেলবে বলে লোকজন নিয়ে বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছে।’ মিলনের মা রাহেমা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাহিদ আমার বুকের মানিককে মেরে ফেলেছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই।’
এ ছাড়া জাহিদ ২০০৩ সালের ১৩ নভেম্বর জয়মঙ্গল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে প্রকাশ্যে সকাল ১১টায় কুন্দারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে হত্যা করেন। এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে নিম্ন আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে হাইকোর্টে আপিল করলে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় জাহিদকে। কিন্তু কিছুদিন সাজাভোগের পর অ্যাপিলেট ডিভিশনের এক আদেশবলে জামিনে বেরিয়ে আসেন জাহিদ। এই জামিনে থাকা অবস্থায়ই কুন্দারপাড়ায় এক পথচারীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ওঠে জাহিদের বিরুদ্ধে।
জাহিদ সরকারের হত্যার শিকার মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন কবিরের বড় ছেলে লতিফুল কবির বলেন, ‘আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে প্রকাশ্যে কুন্দারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে হত্যা করে জাহিদ সরকার। এই হত্যা মামলায় আদালতের দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও সে বাইরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকায় এখনো তার দাপটে কেউ কথা বলতে পারে না। আমাদের মামলা তুলে নিতে নানা হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার খুনির শাস্তি প্রয়োগের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাই।’
জাহিদ এ হত্যাকাণ্ড ঘটালেও তিন দিন পর শিবপুর থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভুঞা মোহনের পরামর্শে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (স্বতন্ত্র) ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নামে হত্যা মামলা করা হয়। বাদী দেখানো হয় নিহতের স্ত্রীকে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় আরো ১৫-২০ জনকে।
এদিকে মিলন হত্যাকাণ্ডে ডিবি ও সিআইডির করা তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে কালের কণ্ঠ’র হাতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের তিন দিন পরে দায়ের হওয়া এজাহারের সময় বাদী শারমিন বেগম স্বামীর শোকে প্রায় পাগল ছিলেন। এমনকি মামলার এজাহারে কাকে আসামি করা হচ্ছিল তাও তিনি জানতেন না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও জিজ্ঞাসাবাদে বাদীর বক্তব্য মামলার এজাহারে বক্তব্যের সঙ্গে না মেলায় বাদীর বক্তব্য সিআরপিসি ১৬১ ধারায় পুনরায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সেদিন জীবন বাঁচাতে মিলন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে দৌড়ানো অবস্থায়ই জাহিদ গলায় ছোরা দিয়ে পোঁচ মারেন। এ সময় দুই হাতে গলা চেপে ধরে সামান্য সামনে যাওয়ার পর মিলন জয়নালের কাঠবাগানে গিয়ে পড়ে যান। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মিলনকে মৃত ঘোষণা করেন।
জানা যায়, নরসিংদী জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসআই রুপন কুমার সরকার ও জেলা সিআইডির এসআই সাহিদুর রহমান ভুঁইয়ার তদন্তে বেরিয়ে আসে মিলন হত্যার মূল রহস্য। একই সঙ্গে এই মামলার হত্যাকারী ও আসামিরাও পাল্টে যায়। আসামি সিরাজুল ইসলাম মোল্লাসহ আটজনের কোনো সংশ্লিষ্টতা না মেলায় তাঁদের অব্যাহতি দিয়ে জাহিদ সরকারসহ চারজনকে আসামি করা হয়।