Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০১ বৃহস্পতিবার, মে ২০২৫ | ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সাদিয়ারা ড্রেনে হারিয়ে যায়

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৫৯ AM
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২:০০ PM

bdmorning Image Preview


নানা ও মামার সঙ্গে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া। চিকিৎসক দেখানোর পর চশমাও কেনেন তিনি। এরপর গাড়িতে করে বাসায় ফিরতে নানার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন চট্টগ্রামের হালিশহরের বাদামতল এলাকার দিকে। হঠাৎই নানার হাত থেকে ছিটকে নালায় পড়ে যান সাদিয়া। সঙ্গে সঙ্গে নালায় ঝাঁপিয়ে পড়েন নানা ও মামা। তারা খুঁজে পাননি। স্থানীয় লোকজন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। শুরুতে তারাও হদিস পায়নি। পরে সিটি করপোরেশনের এক্সক্যাভেটর আনা হয়। তারা প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এক টন আবর্জনা পরিস্কার করে তুলে আনে সাদিয়ার মরদেহ।

নানা হাজি জামাল ঘটনার পর থেকেই থেমে থেমে বিলাপ করে চলেছেন। পরিবারের বড় মেয়েকে হারিয়ে নির্বাক বাবা মোহাম্মদ আলী। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে চাইছেন; কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ভাগ্নিকে হারিয়ে ক্ষুব্ধ মামা জাকির হোসেন। বাসার ভেতর থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের আহাজারি। শোকে কাতর পাড়া-প্রতিবেশীরাও। কেউ কেউ নীরবে ফেলছেন চোখের পানি।

২০ বছর বয়সী সাদিয়া ছিলেন মোহাম্মদ আলী ও শেলী আক্তার দম্পতির প্রথম সন্তান। তাদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সাদিয়া চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। সোমবার রাতে নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেইট এলাকায় নালায় পড়ে তিনি মারা যান। নানা

হাজি জামাল  বলেন, 'কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছি না। নাতনি আমার হাত ধরে ছিল। বৃষ্টিতে পথ পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় পা পিছলে নালায় পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি ও আমার ছেলেও নালায় নেমে পড়ি। অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু স্রোতের জন্য কিছুই করতে পারিনি।'

ভাগ্নিকে হারিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ মামা জাকির হোসেন। তিনি বলেন, 'দেশে কোনো বিচার নেই। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সবকিছু শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এর আগেও এখানে মানুষ পড়েছে; কিন্তু কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। নালায় একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকলে আমার ভাগ্নি পড়ে যেত না।'

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগ্রাবাদের মাজার গেইট পার হয়ে বাদামতলের দিকে ১০ মিটার গেলেই উন্মুক্ত নালা। দু'পাশে দুই থেকে তিন ফুটের চওড়া ফুটপাত থাকলেও প্রায় ১০ ফুট নালাটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। পাশ দিয়ে মাত্র এক ফুটের ঝুঁকিপূর্ণ স্ল্যাব। এই এক ফুট দিয়ে হাঁটতে গিয়ে যে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এখানে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। নেই কোনো সতর্কবার্তাও। ছাত্রীর মৃত্যুর পর গতকাল নালাটি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঘিরে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। পাশে শেখ মুজিব সড়কের ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সিডিএ। নির্মাণকাজের জন্য ফুটপাত সংকোচন করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল দেখতে ভিড় করছেন লোকজন। এ সময় নুরুল ইসলাম নামে এক পথচারী বলেন, 'এখন আর বেড়া দিয়ে কী হবে, যা হওয়ার তো তা হয়ে গেছে। মানুষ মরলেও তাদের টনক নড়ে না।'

আরেক পথচারী বলেন, নগরীতে এখন হাঁটাচলা করাই বিপজ্জনক হয়ে গেছে। পথঘাটগুলো যেন গুপ্তঘাতক হয়েছে। আর কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর আয়োজন করে রেখেছে। কখন কে কোথায় মারা পড়বে, বলা মুশকিল।

ঘটনাস্থলে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার জানান, ফুটপাত ঘেঁষে নালা। কিন্তু নালার ওপর কোনো স্ল্যাব ছিল না। চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের কারণে ওই সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে সেখানে পানি জমে নালার আকার ধারণ করেছে। স্ল্যাব না থাকায় বোঝার কোনো উপায় নেই, নালা নাকি গর্ত।

তিনি জানান, নালা ছিল ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। অনেক চেষ্টা করেও ডুবুরি সেখানে যেতে পারেনি। সেটা আবার টার্ন নিয়েছে কর্ণফুলী নদীর দিকে দক্ষিণে। এরপর দুটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে নালার অন্য অংশের স্ল্যাব উঠিয়ে এক টনের মতো আবর্জনা-মাটি অপসারণ করা হয়। সড়ক থেকে অনেক গভীরে লাশ আবর্জনায় আটকে ছিল। প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টার পর লাশ উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে থাকা ডবলমুরিং থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অর্ণব বড়ূয়া বলেন, 'আবর্জনায় ভরপুর ছিল নালা, যার কারণে নালায় পড়ে আটকে যান ওই ছাত্রী। নালা পরিস্কার থাকলে হয়তো দ্রুত জীবিত উদ্ধার করা যেত।'

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৯৪৬ কিলোমিটার নালা রয়েছে। খাল রয়েছে ১৬১ কিলোমিটার। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ নালার ওপর স্ল্যাব নেই। খালের পাড়ে নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী।

বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন নালা-সড়ক একাকার হয়ে যায়। ফলে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরীক্ষা দেওয়া হলো না সাদিয়ার : বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদিয়ার মিড টার্ম পরীক্ষা চলছে। প্রথম দুটি পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিলেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার তৃতীয় পরীক্ষায় আর অংশ নেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুর খবরে শোকার্ত শিক্ষক ও সহপাঠীরা। গতকাল পরীক্ষা শেষ করে ঘটনাস্থলে এসে মানববন্ধন করেন তার সহপাঠীরা। পরে নগরের বাদামতলী মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন তারা। প্রায় আধঘণ্টা তারা সড়কে অবস্থান করেন। পরে পুলিশ এসে অনুরোধ করে তাদের সরিয়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান তানবীর আহসান সমকালকে বলেন, 'সম্ভাবনাময় একজন ছাত্রীর এভাবে মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মঙ্গলবারও তার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।'
পথে পথে 'মানুষ মারার ফাঁদ':৮০ বছর বয়সী জাহানারা বেগম আজও তার ছেলের অপেক্ষায় আছেন। ছেলে সালেহ আহমেদ ছিলেন সবজি বিক্রেতা। গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে খালে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। এরপর এক মাস পার হলেও তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

এ ঘটনার পর নগরের উন্মুক্ত খাল-নালা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। প্রতিশ্রুতির এক মাসেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কী পরিমাণ খাল-নালা উন্মুক্ত আছে, তার পরিসংখ্যানটুকুও নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। একইভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ)।

এর মধ্যেই সোমবার পা পিছলে নালায় পড়ে মারা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া। একের পর এক এমন মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের মানুষ। এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে নারাজ নাগরিক সমাজ। তাদের মতে, এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। কর্তৃপক্ষ নগরীতে মানুষ মারার ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

২০১৫ সালের জুন থেকে গত ছয় বছরে এভাবে খাল ও নালায় পড়ে নারী-শিশুসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। এক পর্যায়ে তিনি আসন ছেড়ে চলে যান। একই প্রসঙ্গে সিডিএর চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এসব দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।'

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের চট্টগ্রাম নগরীর সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, 'বারবার খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড। এর দায় সিটি করপোরেশন ও সিডিএকে নিতে হবে। এতজন মানুষ মারা যাওয়ার পরও কেন তারা খাল-নালাগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন করছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ভূমিকা নির্বিকার। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা উচিত।'

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'দায়ী কারা- এটা বলব না। এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। রাস্তায় গর্ত হয়েছে। ফুটপাতের ওপর কাদা জমেছে। বৃষ্টিতে সেই কাদা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। কাদার ওপর পা পড়ার পর পিছলে মেয়েটি নালায় পড়ে গেছে বলে শুনেছি।'

তিনি বলেন, 'যারা প্রকল্পের কাজ করছে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। পানিতে রাস্তা এবং নালা এক হয়ে গেছে, মানুষ বুঝবে কীভাবে? খুঁটি গেঁড়ে লাল পতাকা টানিয়ে দিলেও তো মানুষ সতর্ক হতে পারত। যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে তাদের অবহেলা আছে।'

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, 'সিডিএর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কার লাভ হচ্ছে জানি না। যে ঘটনা ঘটেছে, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি শুনেছি নালায় পড়ে আবর্জনায় আটকে মেয়েটি মারা গেছে। নালার ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার করা সিটি করপোরেশনের নিয়মিত দায়িত্ব। এ জন্য মানুষ তাদের ট্যাক্স দেয়।'

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে গিয়ে সড়ক সম্প্রসারণের সময় নালা উন্মুক্ত করা হয়েছে জানানো হলে তিনি বলেন, 'আমাদের প্রকল্পের কাজের কারণে যদি কোনো অবহেলা হয়, তা খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সূত্রঃ সমকাল 

Bootstrap Image Preview