বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে তার মা রোকেয়া খাতুন। তবে রায় দ্রুত বাস্তবায়নসহ পাঁচজনেরও মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে এ রায় দেন আদালত। এ সময় এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসেন আবরারের ছোট ভাই ফায়াজ। দুপুর ১২টার দিকে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে টেলিভিশনে রায়ের খবর দেখেন তারা। এ সময় মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আবরারের মা বলেন, প্রথমে আমি প্রশাসন, মিডিয়া, ছাত্র-অভিভাবকসহ জঘন্য অপরাধের প্রতিবাদকারী সর্বস্তরের জনতাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে যাবজ্জীন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে আদালতের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, আমরা আশা করেছিলাম সবার মৃত্যুদণ্ড হবে। বিশেষ করে হত্যায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল অমিত সাহা। তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ সবাই আশা করেছিল।
তিনি আরো জানান, অমিত সাহার মৃত্যুদণ্ডও যেন অন্যদের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়। আমরা তার মৃত্যুদণ্ডাদেশের আশা করেছিলাম। এর জন্য আবারও আদালতের দ্বারস্থ হব। এই রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। দ্রুততর সময়ে রায় কার্যকর করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক। রায় পুরোপুরি কার্যকর হলে আমরা পুরিপুরি সন্তুষ্ট হব।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, শিবির সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে আবরারকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা বাংলাদেশের সবাইকে ব্যথিত করেছে। এ ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ জন্য তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হলো।
এর আগে ১৪ নভেম্বর এই মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে। ওই দিনই বিচারক রায়ের জন্য ২৮ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। তবে রায় প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক সেদিন রায়ের তারিখ পিছিয়ে ৮ ডিসেম্বর ধার্য করেন।
ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান তার রায়ে বলেন, ‘মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন’ অভিযোগ এনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আবরারকে, ওই ঘটনা বাংলাদেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড যাতে আর কখনো না ঘটে, সেজন্যই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিচ্ছে আদালত।
আবরারের বাবা রায়ের আগে বলেছিলেন, আসামিদের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, এটাই তার প্রত্যাশা।
রায়ের পর চোখেমুখে ছেলে হারানোর বেদনা নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যেদিন বহাল রাখবে, আসামিদের সাজা যেদিন কার্যকর করা হবে; সেদিন আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করব।”
আবরারের হত্যাকারীদের দণ্ড যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়, সরকারের কাছে সেই দাবি তুলে ধরেন বরকত উল্লাহ।
আবরারের মামা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, নিম্ন আদালতের এই রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে তাদের বিশ্বাস।
ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে বুধবার বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যামামলার রায়ের পর সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় আদালতের হাজতখানায়। পরে তাদের কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার সময় আদালত চত্বরে উপস্থিত ছিলেন ইসতিয়াক আহমেদ মুন্নার মা শেলী আহমেদ, অমিত সাহার মা দেবী রানী সাহাসহ আসামিদের পরিবারের সদস্যরা।
সাজা ঘোষণার পর তারা মুষড়ে পড়েন। কেউ একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, কেউ করছিলেন বিলাপ।
যাবজ্জীবনের আসামি অমিতের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, “এ কেমন রায়। আমার ছেলে নির্দোষ, ঘটনার দুই দিন আগে অমিত পূজার জন্য বাড়িতে ছিল। এ কেমন বিচার।”
মুন্নার মা কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। রায় শুনে সঙ্গে আসা দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন শুধু।
আলোচিত এই রায়কে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরে নেওয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মামলার ২৫ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ২২ জনকে সকালে প্রিজনভ্যানে করে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে আদালতে নেওয়া হয়। বাকি তিনজন শুরু থেকেই পলাতক।
বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বেলা ১২টায় এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। পুরো বিচার কক্ষ তখন আইনজীবী, পুলিশ, আর সাংবাদিকে পরিপূর্ণ। দরজার বাইরে বারান্দায়তেও দারুণ ভিড়।
পাঁচ মিনিট পর রায় পাড়া শুরু করে সাড়ে ১২টার দিকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন বিচারক। তিনি পাঞ্জাব হাই কোর্টের বচন সিং বনাম রাষ্ট্র, ভরতের উচ্চ আদালতের মদনগোপাল বনাম রাষ্ট্র, আকবর আলী বনাম রাষ্ট্র মামলার রায় থেকে উদাহরণ টানেন।
বিচারক বলেন, “অপরাধ যথন এতটাই গুরুতর, পূর্ণ শক্তিতে বিচারের তরবারি চালাতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।”
আরেক রায় থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, অপরাধীর যা প্রাপ্য, তাকে তাই দিতে হবে।
রায়ের পর সেই প্রিজনভ্যানে করেই ২২ তরুণকে আবার কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তখন তারা দণ্ডিত আসামি।
প্রিজনভ্যানটি রাখা ছিল আদালতের প্রিজন সেল থেকে ৫০ মিটার দূরে। লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত গাড়িতে উঠে যান বুয়েট এই ‘সাবেক’ শিক্ষার্থীরা।
পাশে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ সদস্য যখন গুনে গুনে তাদের গাড়িতে তুলছিলেন, ভিড়ের মধ্যে একজন আফসোস করে বলে উঠেন- ‘এতগুলো মেধাবী ছেলে, আহারে!’
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে সাংবাদিকদের সামনে এসে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “এ রায়ে আজ দেশ কলঙ্কমুক্ত হল। সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিচারক যেটা ভালো মনে করেছেন, তাই রায়ে এসেছে। আমি পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
“যাদের শাস্তি হয়েছে, তারা যেন বুঝতে পারেন, কী ধরনের অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং ভবিষ্যতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভবিষ্যত শিক্ষকমণ্ডলী যেন এ ঘটনা ভুলে না যান। তারা যেন সতর্ক হন। প্রত্যেকের সজাগ হওয়া উচিৎ, প্রার্থনা করা উচিৎ, কারো জীবনে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে।“
অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাজেদুর রহমান মাজেদ, হোসেন মোহাম্মদ তোহা ও সামছুল আরেফিন রাফাতের আইনজীবী মো. রেজাউল করিম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সম্পূর্ণ রায় পাইনি। রায় পেলে পর্যালোচনা করে আমরা আপিলে যাব। আশা করি সেখানে ন্যায়বিচার পাব।”
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অমিত সাহার আইনজীবী মুনজুর আলম বলেন, “ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত ছিল না। এজাহারভুক্ত আসামি ছিল না। তাকে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে আনা হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”
দণ্ডিতদের প্রিজন ভ্যনে তোলার সময় একজনকে চিৎকার করতে দেখে সাংবাদিকরা জানতে চাইছিলেন- তিনি কার আত্মীয়।
উত্তরে তিনি বলেন, “আমি ২৫ জনেরই বাবা, এ রায় আমি মানি না। “
অন্য মামলায় অনেক সময় রায়ের পর কোনো এক পক্ষকে সাংবাদিকদের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। আবরার হত্যার রায়ের পর তেমনটি দেখা যায়নি।
জাকির হোসেন নামের এক আইনজীবী বললেন, “এটা হৃদয় বিদারক একটা ঘটনা। আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা আসামি তারাও আবরারের মতই মেধাবী। আসলে সব পক্ষেই সহানুভূতি কাজ করছে। সবার হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”