নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী সব দলকে নিয়ে বৃহৎ জোট গঠনে কাজ করছে বিএনপি। এ মাসের মধ্যে সরকারবিরোধী সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষ করতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড। এ জন্য ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছেন তারা। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেউ এককভাবে আবার দলগতভাবে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, বৈঠকে দলগুলো বিভিন্ন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছে। প্রত্যেক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের হাইকমান্ড এসব প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে জোট গঠনের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করবে। বৈঠকে বেশিরভাগ দল জোটের পরিবর্তে যুগপৎ আন্দোলনের পক্ষে সায় দিচ্ছে। আবার অনেকে নির্বাচনকালীন সরকারের এক দফা দাবির বিষয়ে বলছেন। কোনো কোনো দলের নেতারা জাতীয় সরকার ইস্যুতে মাঠে নামার প্রস্তাব দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে। একই সঙ্গে জামায়াত ইস্যুতেও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছে। কেউ জামায়াতের সঙ্গ পুরোপুরি ত্যাগ করার জন্য বললেও বেশিরভাগ দল জামায়াতকে জোটে নয়, যুগপৎ আন্দোলনে পাশে রাখার বিষয়ে মত দিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের এই দুর্বিষহ অবস্থা শুধু বিএনপির নেতাকর্মী নয়, পুরো দেশবাসীকে কষ্ট দিচ্ছে। জনগণের ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সব নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাই। ইতোমধ্যে অনেক দলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা শিগগির সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করব।
সূত্র জানায়, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। এর মধ্যে গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এলডিপি সভাপতির বৈঠক হয়। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান ও এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দুই দলের মধ্যে দূরত্বের অবসান ঘটে। দীর্ঘদিন ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম নিষ্ফ্ক্রিয় থাকায় যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছিল তা এ বৈঠকের মাধ্যমে নিরসন হয়।
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, বিএনপি মহাসচিবসহ কয়েকজন নেতা আমার বাসায় এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এর চেয়ে এখনই জাতীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করা উচিত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করেছে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়ন হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। এ জন্য সবার আগে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাই দরকার জাতীয় সরকার।
গত শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার বৈঠক হয়। বৈঠকে আগামী নির্বাচন, আন্দোলন, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সারাদেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের দলীয়করণ বিষয়ে তাদের আলোচনা হয়।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সব সংগঠন ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য বড় দল হিসেবে বিএনপিকে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের নির্বাচনকালীন সরকারের অভিন্ন দাবিতে রাজপথে নামতে হবে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
এর আগে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক হয়। দলটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক জানান, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তারা তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেছেন। তবে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি কিংবা বাম জোটের অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক হয়নি। এসব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে জোটের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সঙ্গে বিএনপি নেতাদের যোগাযোগ হলেও বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়নি। একইভাবে গণফোরামের সঙ্গেও বিএনপির যোগাযোগ হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এসব দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এখন তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। দেশে আসার পরই এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। ড. মঈন খান বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি দেশে আসছেন। এরপরই এসব দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাদের মতামত নেবেন।
এসব দলের বাইরে গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ডান-বামসহ ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলগুলোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করছে বিএনপি।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ দল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়ে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে বলছেন। বিশেষ করে বাম ঘরানার দলগুলো এই প্রস্তাবনা তুলে ধরছে। দলগুলোর শীর্ষ নেতারা জানান, তাদের বৈঠকগুলো হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈঠকে বিএনপি নেতারা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করাই হচ্ছে এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
বিভিন্ন দলের নেতারা জানান, বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনকালীন জোট গঠন করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটা কোনো নির্বাচনকালীন জোট নয়। এরপরও তারা তাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে তারা কোনো দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য জোট গঠন করতে ইচ্ছুক নয়। ভবিষ্যতে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হবে। এ জন্য বিএনপিকে সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয়ে ঘোষণা দিতে হবে। এর মধ্যে সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তন করতে হবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, দুদক-নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণ করা যাবে না। এ রকম আরও বেশকিছু বিষয়ে শর্তারোপ করা হচ্ছে।
নেতারা জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এসব প্রস্তাবনার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতারা একমত পোষণ করছেন। এসব বিষয় নিয়ে তারা দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বসবেন বলেও তাদের জানানো হয়েছে।