মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুলকে দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাতের পরে স্থানীয় বেসরকারি আল হেলাল হাসপাতালে নিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। কিন্তু সেখানে তাকে কোনো ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়নি। উরুতে ছুরিকাঘাতের কারণে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বুলবুলের। অনেক সময় অপেক্ষা করে তাকে নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসা পেতে দেরি হয়। বুলবুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেতো। পুলিশ কেস বলে হাসপাতাল কোনো চিকিৎসা দেয়নি। শুধু চিকিৎসক বুলবুলের মৃত্যুর ঘটনাই নয়।ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নেয়ার পর বেসরকারি এমনকি অনেক সরকারি হাসপাতালও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে চায় না। ফিরিয়ে দেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। হাসপাতালে গুরুতর রোগী এলে এভাবে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম বছরের পর বছর চলে আসছে। কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। প্রশ্ন উঠেছে গুরুতর রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া এই হাসপাতাল আসলে কেমন হাসপাতাল? আর রোগী ফিরিয়ে দেয়ার এই নিয়মই বা কেমন?
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগ) মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন বলেন, পুলিশ কেস বলে একজন গুরুতর রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা না দেয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য না। যেকোনো গুরুতর আহত ব্যক্তি সে যত বড় অপরাধী হোক না কেন তাকে চিকিৎসা দিতে হবে। এখানে কোনো প্রকার চিকিৎসাজনিত গাফিলতি হলে সেটা আইনের চোখে অপরাধ। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাবর অভিযোগ করার পর সেটা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তদন্ত করে দেখবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পুলিশকে অবগত করা যেতে পারে। কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে যদি এ ধরনের অভিযোগ করা হয় তাহলে বিষয়টি তদন্ত শেষে দোষী প্রমাণিত হলে প্রচলিত ধারা অনুযায়ী অপরাধটি কোন পর্যায়ে সেই হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মামলা হতে পারে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া উয়িংয়ের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, যেটা মামলা হওয়ার যোগ্য অর্থাৎ কেউ একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে ক্ষেত্রে হতে পারে এটা পুলিশ কেস কিনা? কিন্তু এক্ষেত্রে চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীকে প্রথমে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। একই সঙ্গে আইনগত যে বিধিনিষেধ আছে সেটাকেও মেনে চলা। সেবা প্রদানকালীনও বিধিনিষেধগুলো প্রতিপালন করা যায়। দুটোই একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এবং করা উচিত বলে মনে করছি। তিনি বলেন, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত, গুলিবিদ্ধ, মারামারিসহ বিভিন্ন ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি চিকিৎসা শুরুর এমন একটি পর্যায়ে তার মৃত্যু হলো যার কোনো প্রমাণ থাকলো না। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো একজন চিকিৎসকের ওপর বর্তায়। তখন ওই সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল এবং চিকিৎসক এই দায় এড়াতে পারবেন না। কাজেই এই ধরনের রোগীকে জরুরি বিভাগে যেমন চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে একইসঙ্গে পুলিশকে জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে জানানো যেতে পারে। কিন্তু কখনোই চিকিৎসা থেমে থাকার কারণ হতে পারে না যে পুলিশ না এলে চিকিৎসা দেয়া যাবে না। এটা হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
বুলবুল খুনের পর এলাকায়ই ছিল খুনিরা: চিকিৎসক বুলবুলকে ছুরিকাঘাতের পর থেকে পরদিন সকাল প্রায় সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশেপাশে অবস্থান করে দুর্র্বৃত্তরা। বুলবুলের ছিনতাইকৃত মুঠোফোনের অবস্থান থেকে তাদের সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনটি গত রোববার সকাল থেকে পরদিন সকাল ৮টা ২২ মিনিট পর্যন্ত খোলা ছিল। এরপর থেকে ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক যুবকের বাবাকে ইতিমধ্যে পুলিশি হেফাজতে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে ওই যুবক এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ওই যুবক বর্তমানে পলাতক রয়েছে। এবং বুলবুলের ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। নিহত চিকিৎসক বুলবুলের রংপুরের একটি ব্যাংকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে বলে জানিয়েছে তার পারিবারিক সূত্র। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকার দেখছেন স্ত্রী শাম্মী আক্তার।
শাম্মী আক্তার বলেন, বুলবুলকে একা কেন মারলো। তারা আমাদের চারজনকে একসঙ্গে কেন মেরে ফেললো না। দুই সন্তানকে নিয়ে এখন কোথায় যাবো? ওদের ভবিষ্যৎ কি হবে? কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। সংসার আর সন্তানদের ছাড়া বাইরের জগত আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। শুধুমাত্র রংপুরের নিজেদের বাড়ি ছাড়া আর তেমন কিছুই রেখে যায়নি। ২০০৯ সালে নিজেরা ভালোবেসে বিয়ে করে তিলতিল করে সংসারটাকে গড়তে শুরু করেছি। এক ছুরিকাঘাতে সব শেষ হয়ে গেল। তার বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান। বাবার মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরে বুলবুল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার মা। আমাদের একটাই চাওয়া অপরাধীদেরকে দ্রুত শনাক্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি আমার একটি কর্মের ব্যবস্থা হলে হয়তো দুই সন্তানকে মানুষ করতে পারবো।