রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় গতকাল শনিবার তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষিকাকে টিপ পরার কারণে গালি দিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোদ পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী। তিনি তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার।
লতা সমাদ্দার আরো অভিযোগ করেন, সেই সময় তিনি প্রতিবাদ জানালে তার গায়ের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন পুলিশের পোশাক পরা ওই ব্যক্তি।
এদিকে ঘটনার তদন্ত শুরু হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, পোশাক পরিহিত থাকার বর্ণনা এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ বিভিন্ন আলামতে নিশ্চিত হওয়া গেছে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ সদস্য। তবে নাম, মোটরসাইকেলের সম্পূর্ণ নম্বরসহ সুর্নিদিষ্ট কোনো তথ্য না থাকায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে সময় লাগছে। তবে যে কোনো সময় অভিযুক্ত ধরা পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারা।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারের ঘটনার তদন্ত করছি। সংশ্লিষ্ট সবাই দিনরাত কাজ করছে। শিক্ষিকা অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম জানাতে পারেননি। মোটারসাইকেলটির আংশিক নম্বর দিয়েছেন। এসব কারণে দেরি হচ্ছে। তবে বিভিন্নভাবে আমরা এখন পর্যন্ত বলতে পারি অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ সদস্যই। তদন্তে বাকিটা নিশ্চিত হওয়া যাবে। ’
এদিকে ঘটনা জানাজানি হলে শনিবার রাত থেকেই ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন নেটিজেনরা। অনেক নারী টিপ পরা ছবি পোস্ট করে ঘটনার তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। অনেক পুরুষও টিপ পড়ে ফেসবুকে ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
শিল্পীদের ভেতর থেকে এভাবে সম্মিলিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রতিক্রিয়া শেষ কবে এসেছে, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। রাজধানীর বুকে একজন টিপ পরা শিক্ষিকার প্রতি আরেকজন পুলিশ সদস্যের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ছিল- টিপ পরছোস কেন?
প্রশ্নকর্তার তাৎক্ষণিক সেই প্রশ্নের জবাব এবার মিলছে দেশের প্রায় সর্বস্তরের শিল্পী-কুশলীর পক্ষ থেকে। শুধু জবাবই নয়, সোশাল হ্যান্ডেলে নিজ নিজ দেয়ালে শিল্পীরা প্রকাশ করছেন নিজেদের টিপ পরা ছবি এবং ক্যাপশনে মিলছে প্রশ্নের জবাবও। তাই নয়, এই প্রশ্নের জবাবে কিংবা প্রতিবাদে পুরুষ শিল্পীরাও কপালে সেঁটে দিয়েছেন আসল অথবা প্রতীকী টিপ! প্রকাশ করছেন পুলিশ সদস্যের সেই প্রশ্নের প্রতিবাদ।
সাজু খাদেমজনপ্রিয় অভিনেতা সাজু খাদেম কপালে টিপ পরা একটি দারুণ ছবি প্রকাশ করেন সোশাল হ্যান্ডেলে। ক্যাপশন জুড়ে দেন, ‘লাল টিপ... লাল সূর্য...।’ অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর টিপ পরা ছবি প্রকাশ করে লেখেন, ‘টিপের ওপর এমন আঘাত- বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত। নারীর স্বাধীনতার ওপর আঘাত।’
শানুঅভিনেত্রী ও কবি সানারেই দেবী শানু ছবি প্রকাশ করে লেখেন, ‘ধর্ম খুব সংবেদনশীল নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। টিপ পরার দায়ে প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দারকে জনৈক পুলিশের ইভটিজিং ও বাইক দিয়ে প্রাণনাশের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই অসংযত আচরণের বহিঃপ্রকাশকে অবদমিত করা না হলে কদিন পর আর টিপ পরার বিষয়টি আলাদা করে ধর্মীয় ভাবনায় ভাগ হয়ে যাবে। সবাইকে পবিত্র রমজানের শুভেচ্ছা।’
ত্রয়ী ইসলামসঞ্চালক ত্রয়ী ইসলাম লেখেন, ‘টিপ মানেই আমি বাঙালি।’ এদিকে অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি টিপ পরা ছবি প্রকাশ করে বেশ কড়া ভাষায় বলেন, ‘আমার শরীর, আমার সাজ, আমার সংস্কৃতি- আমার স্বাধীনতা। এখানে নাক গলাতে এলে নাকটা কেটে দেওয়া হোক। তীব্র প্রতিবাদ জানাই, অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। অপশক্তির দাপট ঠেকানো হবেই।’
নাজমুল হোসাইনদেশের অন্যতম বাচিক শিল্পী নাজমুল হুসাইন নিজের কপালে টিপ লাগিয়ে বলেন, ‘বহুদিন যাবৎ চেষ্টা করছিলাম, দোজখ দেখার এবং সামান্য অভিজ্ঞতার; কিন্তু কোনোভাবে দোজখের সন্ধান পাচ্ছিলাম না। এবার মনে হয় পাবো। টিপ পরলাম, দোজখ ঘুরে আসার জন্য। ফিরে এসে আপনাদের জানাবো আমার অভিজ্ঞতা। দোজখে যাবার আশীর্বাদ চাই।’
স্বাধীন খসরুঅভিনেতা-প্রযোজক স্বাধীন খসরু টিপ পরা ছবি প্রকাশ করে লেখেনে, ‘সংহতি টিপ।’ এদিকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী দীপান্বিতা মার্টিন ছবির সঙ্গে মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন একটি উক্তি প্রকাশ করেন। সেটি হলো, ‘You can’t depend on your eyes. When your imagination is out of focus.’
নির্মাতা ও সংগীতশিল্পী মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ছবি ছাড়াই প্রতিবাদ করেন নিজের ভাষায়। বলেন, ‘যেকোনও ঘটনা নিয়ে অতি চর্চা করতে গিয়ে লেজে-গোবরে করা আমাদের মজ্জাগত সমস্যা। টিপকাণ্ডে জড়িত পুলিশ সদস্য কোনোভাবেই সুস্থ মানসিকতার হতে পারে না! পুলিশের উচিত বাহিনী থেকে এই অসুস্থ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, এটা পুলিশের ইমেজের জন্যই জরুরি।’
ফারজানা চুমকীঅভিনেত্রী ফারজানা চুমকী ছবি প্রকাশ করে বলেন, ‘টিপ আমি পরবোই।’ অন্যদিকে অবসকিওর ব্যান্ড নেতা টিপু নিজ কপালে টি পরে বলেন, ‘টিপ, ভালোবাসার চিহ্ন।’ অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা ছবি প্রকাশ করে হ্যাশট্যাগ দেন #টিপপরছোসকেন!
বিপ্লব সাহাএছাড়াও রবিবার সন্ধ্যা নাগাদ কোনও ক্যাপশন ছাড়া কপালে টিপ পরা ছবি প্রকাশ করে এই প্রতিবাদে সংহতি জানিয়েছেন, অভিনেতা প্রাণ রায়, আনিসুর রহমান মিলন, মনোজ প্রামাণিক, অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকী, আজমেরী হক বাঁধন, সুষমা সরকার, কুসুম শিকদার, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী ও আয়েশা মনিকা, চিত্রনায়িকা অধরা খান, ফ্যাশন ডিজাইনার ও গাতক বিপ্লব সাহা, কণ্ঠশিল্পী মিতু কর্মকার প্রমুখ।
প্রাণ রায়এভাবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের শিল্পী-কুশলী কপালে টিপ লাগানো ছবি পোস্ট করে যার যার মতো করো প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সোশাল হ্যান্ডেলে। শিল্পীদের এই প্রতিবাদের পালে মূলত হাওয়া লাগে কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফার কণ্ঠস্বর ধরে। তিনি জাতীয় সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের কোন আইনে আছে টিপ পরা যাবে না? সংসদে তিনি বলেন, ‘দল-মত নির্বিশেষে বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য অত্যন্ত ঘৃণিত একটি ঘটনা। ইভটিজিং আমরা শুনে এসেছি। বখাটে ছেলেরা স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের টিজ করে। সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমি যখন দেশের আইনরক্ষাকারী কাউকে ইভটিজিংয়ের ভূমিকায় দেখি, তখন সেটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
সংসদে সুবর্ণা মুস্তাফাযোগ করেন, ‘বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না। এখানে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এমনকি সে বিবাহিত না বিধবা সেটা বিষয় নয়...একটি মেয়ে টিপ পরেছে। তিনি একজন শিক্ষক। রিকশা থেকে নামার পর দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার তাকে টিজ করেছে।’
ওই শিক্ষক এমন ঘটনার প্রতিবাদ জানালে তার সঙ্গে তুই তোকারি করা হয়েছে উল্লেখ করে সুবর্ণা বলেন, ‘তাকে অসম্মান করা হয়েছে। আমি সরকারি দলকে রিপ্রেজেন্ট করি, নাকি বিরোধী দলকে রিপ্রেজেন্ট করি- বিষয়টা এগুলোর ঊর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেন, মানুষ আগে। মানুষের অধিকার আগে। জাতির পিতা বলেছেন, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের অধিকার আগে।’
আয়েশা মনিকাসংরক্ষিত এই নারী আসনের সদস্য বলেন, ‘যে মন্ত্রণালয় এই বিষয়টি দেখাশোনা করে তারা যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।’
অধরা খানপ্রসঙ্গত, শনিবার (২ এপ্রিল) রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্তের শিকার হন তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘হেঁটে কলেজের দিকে যাওয়ার সময় হুট করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন- ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই বাজে গালি দেন তাকে। ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তির গায়ে পুলিশের পোশাক।’’
মনোজ প্রামাণিকঘটনার প্রতিবাদ জানালে একপর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যায় সেই ব্যক্তি। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন লতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করছেন অগুনতি মানুষ।
আনিসুর রহমান মিলন